সমস্ত লেখাগুলি

নাস্তিকতা - একটি পর্যালোচনা -
পার্থ সারথি চন্দ্র
Dec. 3, 2024 | নাস্তিকতা | views:939 | likes:6 | share: 5 | comments:0

১৬৩৩ সাল। পৃথিবী সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে - বাইবেল বিরোধী এই সত্য কথা বলার অপরাধে তৎকালীন চার্চ খ্যাতনামা বিজ্ঞানী গ্যালিলিওকে অভিযুক্ত করলো ‘ধর্মদ্রোহিতার’ অভিযোগে। গ্যালিলিও তখন প্রায় অন্ধ, বয়সের ভারে ন্যুব্জ। অসুস্থ ও বৃদ্ধ বিজ্ঞানীকে জোর করে ফ্লোরেন্স থেকে রোমে নিয়ে যাওয়া হলো, হাঁটু ভেঙ্গে সবার সামনে জোড় হাতে ক্ষমা প্রার্থনা করিয়ে বলতে বাধ্য করা হয় এতদিন গ্যালিলিও যা প্রচার করেছিলেন, তা ধর্মবিরোধী, ভুল ও মিথ্যা। বাইবেলে যা বলা হয়েছে সেটিই আসল, সঠিক। পৃথিবী স্থির অনড় - সৌর জগতের কেন্দ্রে। গ্যালিলিও প্রাণ বাঁচাতে তাই করলেন। পোপ ও ধর্মসংস্থার সম্মূখে গ্যালিলিও যে স্বীকারোক্তি ও প্রতিজ্ঞা-পত্র স্বাক্ষর করেন, তা বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে ধর্মীয় মৌলবাদীদের নির্মমতার এবং জ্ঞান সাধকদের কাছে বেদনার এক ঐতিহাসিক দলিল।

শোনা যায়, এর মধ্যেও একবার আকাশের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধ গণিতজ্ঞ-জ্যোতির্বিদ স্বগতোক্তি করেছিলেন - ‘তার পরেও কিন্তু পৃথিবী ঠিকই ঘুরছে’। ধর্মদ্রোহিতার অভিযোগ নিয়েই গ্যালিলিওর মৃত্যু হয় ১৬৪২ সালে, নিজ গৃহে, অন্তরীণ অবস্থায়। শুধু গ্যালিলিওকে অন্তরীণ করে নির্যাতন তো নয়, ব্রুনোকে তো পুড়িয়েই মারলো ঈশ্বরের সুপুত্ররা। তারপরো কি সূর্যের চারিদিকে পৃথিবীর ঘোরা ঠেকানো গেল?


শুধু গ্যালিলিও বা ব্রুনো নয়, ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, হাইপেশিয়া, এনাক্সোগোরাস, ফিলিপ্রাস প্যারাসেলসাস, এনাকু সিমন্ড, লুসিলিও ভানিনি, টমাস কিড, ফ্রান্সিস কেট, বার্থৌলোমিউ, লিগেট, ইবনে খালিদ, যিরহাম, আল দিমিস্কি, ওমর খৈয়াম, ইবনে সিনা, ইবনে বাজা, আল কিন্দী, আল রাজি কিংবা ইবনে রুশদ সহ অনেককেই ধর্মান্ধদের হাতে নিগৃহীত এবং নির্যাতিত হয়ে নিহত হতে হয়।


মানব সভ্যতার সূচনা পর্বে ধর্ম ছিল জাদুবিদ্যাকেন্দ্রিক। মানব গোত্রের প্রধান পুরোহিত, যাজক, পয়গম্বরা ছিলেন আসলে জাদু ও তন্ত্রে পারদর্শী। বহুকাল আগে, জঙ্গলে বসবাসকারী মানুষের এক গোত্রের কথা চিন্তা করা যাক। গোত্রের সব মানুষের সামনে একজন সামান্য জ্বলন্ত আগুনে ছুঁড়ে দিলেন মুঠোভর্তি কালো গুঁড়ো। সঙ্গে সঙ্গে তীব্র বিস্ফোরণে আগুনের শিখা উপরে উঠে গেল। দর্শকদের কাছে ঘটনাটি গণ্য হলো অপ্রাকৃত এবং অসাধারণ হিসেবে। এবং এই ‘অতিপ্রাকৃত ঘটনা’ সবার সামনে ঘটানোর জন্য সামান নিজেকে দাবি করলেন সবার চেয়ে আলাদা একজন, বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হিসেবে। এই থেকেই অতি প্রাচীনকালে উৎপত্তি হয়েছিল দেবতা, ভূত ও ভগবানের। তাদের তুষ্ট করতে শুরু হয়েছিল পুজো, বলিদান, উৎসর্গ উপাচারের মতো রীতি পালনের। সৃষ্টি হয়েছিল ধর্মের। তৈরি হয়েছিল জাত-পাত। প্রাচীন ভারতে এসব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন চার্বাকরা। যাঁরা এইসব অযৌক্তিক, ব্যাখ্যাহীন, অজ্ঞানতায় মোড়া, কুসংস্কার সর্বস্ব কাণ্ডকারখানায় মজে থাকতেন তাদের জ্ঞানের অপর্যাপ্ততা আছে বলে মনে করতেন চার্বাকরা।


ভাবা হয়েছিল যত সময় এগোবে, শিক্ষার প্রসার হবে, জ্ঞানের বিকাশ হবে এই সব কুসংস্কার, অলৌকিকতা থেকে মুক্ত হবে মানুষ। কিন্তু পৃথিবীর ইতিহাস সে পথে হাঁটেনি। খোলামকুচির মত উড়ে গেছে চার্বাকদের তত্ত্ব। জ্ঞান-বিজ্ঞানের সৃষ্টি করা আধুনিক উপকরণকে গ্রহণ করলেও, তার আলোকে ঈশ্বরতত্ত্ব থেকে মুক্ত হতে পারেনি মানুষ। নিজের কাজ দিয়ে, আবিষ্কার দিয়ে এক ধাক্কায় জ্ঞানের জগতকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এমন বহু মানুষ ছিলেন নাস্তিক। কিন্তু তাতে কার কি? ধর্মান্ধ ও কুসংস্কারগ্রস্থ, স্থবির সমাজ, রাষ্ট্র বা গোষ্ঠী তাকে হয় নির্বাসনে পাঠিয়েছে না হয় হত্যা করেছে। যত দিন যাচ্ছে ততই আরও ধর্মোন্মাদ, কুসংস্কারমুখী হয়ে পড়ছে মানুষ। তৈরি হচ্ছে এক অদ্ভুত মনুষ্যমন যেখানে অন্য ধর্মের, অন্য মতের মানুষের কোনও ঠাঁই নেই। তাই উপাসনালয় বানিয়ে পুজোপাঠের শেষ নেই। অন্ত নেই তার ধুমধাম আর জাঁকজমকের। পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতের ভোটবাজার এখনও নির্ভর করে ধর্মের মেরুকরণের উপরই। তাই মন্দির না মসজিদ, সেটাই আগামী ভারতের সবচেয়ে বড় ভাবনা।


কীভাবে অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ব্যবস্থা টিকে আছে, কীভাবে আমরা এই অন্ধবিশ্বাসগুলো বংশ পরম্পরায় প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দিই, তা বুঝতে হলে সামাজিক জীববিজ্ঞানের আধুনিক গবেষণাগুলোকে বুঝতে হবে। রিচার্ড ডকিন্স তার ‘সেলফিশ জিন’ বইয়ে আর সুজান ব্ল্যাকমোর তার ‘মিম মেশিন’ বইয়ে কীভাবে বিশ্বাস বংশপরম্পরায় টিকে থাকে অনেক আকর্ষণীয় উদাহরণ হাজির করেছেন।


‘নাস্তিক’ শব্দটির মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে অবিশ্বাস করে। ‘আস্তিক’ মানে যে ঈশ্বর ও ধর্মে বিশ্বাস করে। বিষয়টি যদি এটুকুতেই সীমাবদ্ধ থাকতো, তাহলে আমাকে এই আলোচনার অবতারণা করতে হত না।

"কেবলং শাস্ত্রমাশ্ৰিত্য ন কর্তব্য বিনির্ণয়।

যুক্তিহীন বিচারেণ ধর্মহানিঃ প্ৰজায়তে।।"

- এটা আমার বচন নয়, শাস্ত্রীয় বচন। আমি নাস্তিক। শাস্ত্র আমার জীবন নিয়ন্ত্রণ করে না। অর্থাৎ আমি বস্তুত অশাস্ত্রীয় মানুষ। যুক্তিহীন ধর্মকথা মান্য করে পুণ্যলাভের বাসনা আমার নেই। বরং শাস্ত্রমতে যুক্তিহীন বিচারে ধর্মের ক্ষতিসাধন হয় বল আমি বিশ্বাস করি। এটাই আমার বিশ্বাস, আমার ধর্মানুভূতি। কল্পনাবিলাসে নাস্তিকরা অভ্যস্ত নয়।


ধর্ম আসলে কী? চুম্বকের ধর্ম যেমন আকর্ষণ করা, মানুষের ধর্ম তেমনি বিশ্বমানবতা, মানুষের প্রতি প্রেম এবং ভালোবাসা৷ এরকম হলে কোনও আপত্তি ছিল না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে, পরস্পরের মধ্যে শ্রেষ্টত্বের লড়াই শুরু হয়৷ কার ঈশ্বর সত্য, কার ধর্ম সত্য - এই সব কোন্দলে এখনও পর্যন্ত কোটি কোটি মানুষের জীবন চলে গেছে, অনেক রক্ত ঝরেছে৷ তাই প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম, মানব ধর্মের এবং মানবতার বিরুদ্ধে৷ আমাদের কোনো সৃষ্টিকর্তা নেই, সেটা থাকার কোনো দরকারও নেই৷ মহাবিশ্ব পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্রানুসারেই চলে, এখানে সৃষ্টিকর্তা বলে কিছুর প্রয়োজন নেই৷ স্টিফেন হকিং সেটা ব্যাখ্যা করেছেন তাঁর বইতে৷ ঈশ্বরের কোনো প্রমাণও এখন পর্যন্ত কেউ দিতে পারেনি৷ যেদিন কেউ ঈশ্বরের প্রমাণ দিতে পারবে, আমার আস্তিক হয়ে যেতে আপত্তি থাকবে না। চ্যাপম্যান কোয়েন বলেছেন, “ঈশ্বর খুবই ভঙ্গুর, বিজ্ঞানের ছোট্ট একটি ফুলকি অথবা একটু সাধারণ জ্ঞানই তাকে শেষ করে ফেলতে সক্ষম।” বিজ্ঞানী স্টিফেন ভাইনবার্গের একটি চমৎকার উদ্ধৃতি এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, “ধর্ম মানবতার জন্য এক নির্মম পরিহাস। ধর্ম মানুক বা নাই মানুক, সবসময়ই এমন অবস্থা থাকবে যে ভালো মানুষেরা ভালো কাজ করছে, আর খারাপ মানুষেরা খারাপ কাজ করছে। কিন্তু ভালো মানুষকে দিয়ে খারাপ কাজ করানোর ক্ষেত্রে ধর্মের জুড়ি নেই।”


মৃত্যুর পরে আমাদের শরীর মাটিতে মিশে যায়৷ যেহেতু আমি মানে হচ্ছে, আমার মস্তিষ্ক, যেখানে আমার সব স্মৃতি সংরক্ষিত থাকে, আবেগ ভালোবাসা সব কিছুর কেন্দ্র যেটা, সেই মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেলেই আমার অস্তিত্ব সেখানেই শেষ৷ সেই মগজ যখন মাটিতে মিশে যায়, আমরা আবার আমাদের প্রকৃতিতে ফিরে যাই৷


দুই ধরনের নাস্তিক রয়েছেন। দুই দলই মনে করেন ধর্ম মানব সমাজের জন্য ক্ষতিকর৷ এদের একদল মনে করেন ধর্ম এমনিতেই ধ্বংস হয়ে যাবে সময়ের প্রয়োজনে, তার জন্য কিছু করার প্রয়োজন নেই৷ আরেক দল মনে করেন, ধর্মকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা করতে হবে৷ আঘাত করতে হবে৷ তবে সেটা কোন শারীরিক আঘাত নয়, লেখার মাধ্যমে নিজেদের যুক্তি তুলে ধরে, কোনো মতবাদকে ভুল ও মিথ্যা তা দেখিয়ে দেয়া৷


'সেক্যুলার' শব্দের মানে কি সত্যিই সকল ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা? অন্তত রাষ্ট্রীয়ভাবে আমাদের দেশে এখন এটাই প্রচার করা হয়। বিভ্রান্তি সে কারণেই। আসলে কিন্তু ‘সেক্যুলারিজম’ শব্দটির অর্থ - ‘সব ধর্মের প্রতি সমান শ্রদ্ধা’ নয়, বরং এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে একটি মতবাদ, যা মনে করে -  রাষ্ট্রীয় মূলনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখা উচিত। 'আমেরিকান হেরিটেজ' ডিকশনারিতে 'Secularism' শব্দটিকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে এভাবে – “The view that religious considerations should be excluded from civil affairs or public education.” এ সংজ্ঞা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ধর্মকে রাষ্ট্রের কাজের সাথে জড়ানো যাবে না - এটাই সেক্যুলারিজমের মোদ্দা কথা। ধর্ম অবশ্যই থাকতে পারে, তবে তা থাকবে জনগণের ব্যক্তিগত পরিমণ্ডলে - ‘ব্যক্তিগত’ বিষয় হিসেবে; ‘জনসাধারণের’ ব্যাপার স্যাপারে তাকে জড়ানো যাবে না। স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরু সেক্যুলারিজমের প্রকৃত সংজ্ঞা অনুধাবণ করতে পেরেছিলেন ভালোভাবেই। তিনি রাষ্ট্রীয় কার্যাবলী থেকে ধর্মকে পৃথক রাখাই সঙ্গত মনে করতেন, জাতীয় জীবনে সব ধর্মের প্রতি উদাসীন থাকাটাই তার কাছে যুক্তিযুক্ত মনে হতো। তিনি বলেছিলেন, “ধর্ম বলতে যে ব্যাপারগুলোকে ভারতে কিংবা অন্যত্র বোঝানো হয়, তার ভয়াবহতা দেখে আমি শঙ্কিত এবং আমি সবসময়ই তা সোচ্চারে ঘোষণা করেছি। শুধু তাই নয়, আমার সবসময়ই মনে হয়েছে এ জঞ্জাল সাফ করে ফেলাই ভালো। প্রায় সব ক্ষেত্রেই ধর্ম দাঁড়ায় ধর্মান্ধতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, মূঢ়তা, কুসংস্কার আর বিশেষ মহলের ইচ্ছার প্রতিভূ হিসেবে।”


আসলে অভিধানে 'Secular' শব্দটির অর্থও করা হয়েছে এভাবে - ‘Worldly rather than spiritual’। সেক্যুলারিজমের অন্যান্য প্রতিশব্দগুলো হলো - Worldly, Temporal কিংবা Profane। শব্দার্থগুলো খুব ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, এর অবস্থান ধর্ম কিংবা আধ্যাত্মিকতার দিকে নয়, বরং এর একশ আশি ডিগ্রি বিপরীতে। সেজন্য, সেক্যুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ অনেকে খুব সঠিকভাবেই করেন - ‘ইহজাগতিকতা’।


সেক্যুলারিজমের মূল সুরটি আত্মস্থ করার পরিবর্তে চলছে ছদ্ম-ধর্মনিরপেক্ষতা জাহির করার মহড়া। এ প্রসঙ্গে প্রবীর ঘোষ তার ‘সংস্কৃতি, সংঘর্ষ ও নির্মাণ’ বইয়ে লিখেছেন – “বিপুল প্রচারে সাধারণ মানুষ পরিচিত হয়েছে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দের সাথে। জেনেছে, ধর্মনিরপেক্ষতা কথার অর্থ হলো - ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’। বিপুল সরকারি অর্থব্যয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দের এই যে ব্যাখ্যা হাজির করা হচ্ছে এবং এরই সাথে সম্পর্কিতভাবে আমাদের দেশের মন্ত্রী, আমলা ও রাজনৈতিকেরা মন্দিরে মন্দিরে পুজো দিয়ে বেড়াচ্ছেন, গুরুদ্বোয়ারায় নতজানু হচ্ছেন, মসজিদে গির্জায় শ্রদ্ধা জানিয়ে আসছেন। দীপাবলি, ঈদ, বড়দিন ইত্যাদিতে রাষ্ট্রনায়কেরা বেতার, দূরদর্শন মারফৎ শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে অর্থ সাহায্য দিলে আয়কর থেকে রেহাইয়ের ব্যবস্থা করে দিচ্ছেন।

 

সাধারণের ভালো লাগছে - ‘সব ধর্মের সমান অধিকার’ মেনে নিয়ে মন্ত্রী, আমলা, রাজনীতিকদের সমস্ত ধর্মের কাছে নতজানু হতে দেখে। উদার হৃদয়ের মানুষ হিসেবে নিজেদের ভাবতে ভালো লাগছে জনগণের – হুঁ-হুঁ বাবা, আমাদের দেশ ধর্মনিরপেক্ষ। এখানে সব ধর্মই সমান অধিকার ও শ্রদ্ধা পায় মন্ত্রী আমলাদের। মন্ত্রীরা এরই মাঝে জানিয়ে দেন সমস্ত ধর্মের সমান অধিকার বজায় রাখতে, দেশের ‘ধর্মনিরপেক্ষতার মশাল’ জ্বালিয়ে রাখতে হবে।

 

‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটিকে নিয়ে কী নিদারুণভাবে অপব্যাখ্যা করে সাধারণ মানুষের মগজ ধোলাই করা হচ্ছে ভাবা যায় না। ‘নিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ কোনো পক্ষে নয়। ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দের অর্থ তাই ‘কোনো ধর্মের পক্ষে নয়’- অর্থাৎ, সমস্ত ধর্মের সঙ্গে সম্পর্ক বর্জিত। 'Secularism' শব্দের আভিধানিক অর্থ - একটি মতবাদ - যা মনে করে রাষ্ট্রনীতি, শিক্ষানীতি প্রভৃতি ধর্মীয় শাসন থেকে মুক্ত থাকা উচিত।

 


কিন্তু এ কী! এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার নামে আমরা কী দেখাচ্ছি? সেক্যুলার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানেও এদেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করা হয়। কোনো প্রকল্পের উদ্বোধন বা শিলান্যাস করা হয় মন্ত্রোচ্চারণের প্রদীপ জ্বালিয়ে, পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন করা হয় নারকেল ফাটিয়ে। রাজনীতির ব্যবসায়ীরা ‘সেক্যুলারিজম’- এর নামে নানা ধর্মকে তোল্লাই দিয়ে সর্বধর্মের সমন্বয় ও সংহতির বাধা গৎই এতদিন বাজিয়ে এসেছেন।”


সেক্যুলারিজম বহু শতাব্দী ধরে (আমাদের উপমহাদেশে) যে ভাবে আচরিত এবং রূপান্তরিত হয়ে আসছে, ‘ধর্মনিরপেক্ষতাকে’ই যদি তার ঠিক বঙ্গানুবাদ বলে ধরে নেই, তবে শুধুমাত্র সব ধর্মের সহাবস্থানেই তার অর্থ পুরোপুরি ধরা পড়ে না। এ কথা সত্য যে, ধর্মনিরপেক্ষতায় তার প্রয়োজন আছে, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়, ধর্ম থেকে চিন্তার মুক্তিতেই ধর্মনিরপেক্ষতা পূর্ণতা পায়। ইতিহাসের পরিক্রমায় দেখা যায়, খুব কম মানুষই পারে আজন্ম লালিত ধ্যান ধারণাকে পরিত্যাগ করে স্বচ্ছভাবে চিন্তা করতে, খুব কম মানুষই পারে স্রোতের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে। খুব কম মানুষের মধ্যে থেকেই শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে আসেন প্রবীর ঘোষ কিংবা পেরিয়ার স্বামী।


বেশিরভাগ ড্যানিশ এবং সুইডিশ ধর্ম দ্বারা সংজ্ঞায়িত ‘সিন’ বা 'পাপ' নামক কোনো ব্যাপারে বিশ্বাসী নন অথচ দেশ দু’টিতে অপরাধ প্রবণতার হার পৃথিবীর সকল দেশের তুলনায় সর্বনিম্ন। এই দুই দেশের প্রায় কেউই চার্চে যায় না, পড়ে না বাইবেল। তারা কি অসুখী? ৯১ টি দেশের মধ্যে করা এক নিরীক্ষি অনুযায়ী, সুখী দেশের তালিকায় ডেনমার্কের অবস্থান প্রথম, যে ডেনমার্কে নাস্তিকতার হার মোট জনসংখ্যার প্রায় শতকরা আশি ভাগ। স্ক্যান্ডিনেভিয়ায় মাত্র ২০ শতাংশের মতো মানুষ ঈশ্বরের বিশ্বাস করেন, তারা মনে করেন ভালোভাবে বেঁচে থাকার জন্য ঈশ্বরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। বিশ্বাস করেন, মৃত্যুর পরের জগতে। আর বাকিরা স্রেফ কুসংস্কার বলে ছুঁড়ে ফেলেছেন এ চিন্তা।


ঈশ্বরহীন এইসব সমাজের অবস্থা তবে কেমন? সমাজের অবস্থা মাপার সকল পরিমাপ - গড় আয়ু, শিক্ষার হার, জীবন যাপনের অবস্থা, শিশুমৃত্যুর নিম্নহার, অর্থনৈতিক সাম্যাবস্থা, লিঙ্গ সাম্যাবস্থা, স্বাস্থ্যসেবা, দুর্নীতির নিম্নহার, পরিবেশ সচেতনতা, গরীর দেশকে সাহায্য সবদিক দিয়েই ডেনমার্ক ও সুইডেন অন্যান্য সকল দেশকে ছাড়িয়ে সবচেয়ে উপরে। তবে পাঠকদের আমি এই বলে বিভ্রান্ত করতে চাই না যে, এইসব দেশে কোনো ধরনের সমস্যাই নেই। অবশ্যই তাদেরও সমস্যা আছে। তবে সেই সমস্যা সমাধানের জন্য তারা যৌক্তিক পথ বেঁছে নেন, উপর থেকে কারও সাহায্যের অপেক্ষা করেন না, কিংবা হাজার বছরের পুরোনো গ্রন্থ ঘেঁটে সময় নষ্ট করেন না।


অনেকে বলেন, দিন দিন যা দেখছি, সেদিন বেশি দূরে নয় যখন নাস্তিকতা একটি ধর্মে পরিণত হবে। আমি বলি, উঁহু, নাস্তিক্যবাদ কোনো ধর্মতত্ত্ব নয়। ধর্মতত্ত্ব ঈশ্বর ধারণার উপর প্রতিষ্ঠিত। যেখানে ঈশ্বর নেই, সেখানে ধর্মতত্ত্বের ভিত্তি নেই। ধর্ম তাকেই বলি, যা ঈশ্বরবিশ্বাস ও ঈশ্বর প্রদত্ত অনুশাসনকে বোঝায়। নাস্তিক্যবাদে ঈশ্বর অনুপস্থিত। নাস্তিক্যবাদীরা ঈশ্বর ও ঈশ্বরের নামে অনুশাসনকে অস্বীকার ও বিরোধিতা করে। নাস্তিক্যবাদীরা মনে করেন মানুষকে সুপথে চালিত করতে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন ও বিজ্ঞানই যথেষ্ট। ধর্ম মানে কয়েকটি ভুর্জপত্রে লিখন নয়, যা মেনে চললেই ধার্মিক হওয়া যায় আর না মানলেই নরকের কীট! মানুষের ধর্ম - মানুষের মানবিক গুণ, যা মানুষকে অন্য প্রাণীর থেকে আলাদা করে। আসলে নাস্তিক বলে আলাদা করে ব্যাখ্যা দেওয়ার মতো কিছু আছে বলে মনে হয় না। তবে নাস্তিক, নির্ধার্মিক, অজ্ঞেয়বাদী, সংশয়বাদী - এদের মধ্যে কোনো প্রথাগত বিভেদ নেই, যা আছে তা হল সব বুদ্ধিগত এবং অহিংসতা।


পৃথিবীজুড়ে আস্তিকদের ধর্মচর্চা, ঈশ্বরচর্চার পাশাপাশি চিরকালই বিপরীত স্রোত হিসেবে থেকেছে অবিশ্বাস এবং যুক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নাস্তিক্যবাদ। এক সময় পৃথিবী জুড়ে ছড়িয়ে পড়া কমিউনিজম-এর প্রভাবে নাস্তিকদের সংখ্যা বাড়লেও বর্তমানে তা নিম্নমুখী। কলেজ স্ট্রিটের কানাগলি থেকে প্রকাশিত ‘বিজ্ঞান ও নাস্তিকতা’ নামে অতি চটি একটি পত্রিকায় লেখক ভবানীপ্রসাদ সাহু বিভিন্ন তথ্য ঘেঁটে নাস্তিকদের একটা সংখ্যাতত্ত্ব  প্রকাশ করেছিলেন ২০০৫ সালে। এতে বলা হয়েছে ১৯৯২ সাল নাগাদ বিশ্বের জনসংখ্যার ২০.৪ শতাংশ ছিল নাস্তিক বা ঘোষিত নিরীশ্বরবাদী। ১৯৯৬ সালে সেই সংখ্যা হয় ১৯ শতাংশ এবং ২০০২ সালে তা পৌঁছোয়  ১৫ শতাংশে। এই মুহূর্তে উইকিপিডিয়া খুলে 'উইন-গ্যালপ ইন্টারন্যাশনালের' করা সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী দেখা যাচ্ছে ২০১২ সালে নাস্তিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১৩ শতাংশে, ২০১৫ সালে  ১১ শতাংশে এবং ২০১৭ সালে ৯ শতাংশে। 


সবার ফেসবুকে উপছে পড়া ভক্তি, সবার হোয়াটসঅ্যাপে ধর্মের ডিজিটাল বাণী। এর মধ্যেখানেই বকচ্ছপ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে নাস্তিকতার পাঠ নিয়ে বসা মানুষটা। বন্ধু-বান্ধব আত্মীয় স্বজন মায় পরিবারের মধ্যেও সে একা। সে অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে এক সময় ইতু পুজো, নানা রকমের ষষ্ঠী, সন্তোষী মার ভক্ত পরিবার কিভাবে যেন জড়িয়ে পড়েছে গোপাল ঠাকুরের পুজোয়। পাড়ার মোড়ে দিব্যি জমে গেছে গোপালের সিংহাসন, মুকুট, পোশাক, বিছানা, মশারি বিক্রির দোকান। সেক্টর ফাইভে সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করা জিন্স আর টপ পরা মেয়েটা হাতে দিব্যি বেঁধে রেখেছে লাল বিপত্তারিনীর সুতো। বাবার বার বলে সোমবার উপোষ করছে ১৯-২০র ছেলেরা। অথচ এই বঙ্গেই এক সময় ভূত-ভগবান-শয়তান-এর বিরুদ্ধে কোমর কষে লড়াইয়ে নেমেছিলেন গণ বিজ্ঞান আন্দোলনের মানুষজন।

আত্মীয়-স্বজন, সমাজ-সংসারের দাবি সামলাতে গিয়ে ব্যক্তিগত মতামত, স্বাধীনতার পরিসর কমেই যাচ্ছে নাস্তিক কুলের। কারণ, তার জন্য কোনও স্বস্তির জায়গা নেই। কালিপুজোর সময় শব্দবাজির অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে ঠিক কোথায় গেলে শান্তি মিলবে, তা যেমন সারমেয়রা বুঝতে পারে না, এ অবস্থা অনেকটা যেন তাই। গোটা পৃথিবী জুড়ে, গোটা দেশ, এ পাড়া-সে পাড়া, এমনকি ঘরের ভেতর যেভাবে অতিভক্তির আধিক্য বাড়ছে, তাতে নাস্তিকরা বিপন্ন বইকি। এ বিপন্নতা যাঁরা একটু অন্যভাবে বাঁচতে চান তাদেরও।

এখন প্রকাশ্যেই নাস্তিকতার পক্ষে লেখালেখি হচ্ছে - যে বিষয়টা একসময় কল্পনাও করা যেত না। নিজেকে নাস্তিক সাজিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে থাকার মধ্যে কোন সার্থকতা নেই। এই নিরন্তর লড়াই চলছে, চলবে। যতদিন না পৃথিবী থেকে ধর্মান্ধতা দূর করা যাবে, যতদিন না ধর্মীয় অন্ধবিশ্বাসের নামে মানুষকে অন্ধকারে ঠেলে দেওয়া বন্ধ না হবে, যতদিন না মানুষ প্রকাশ্যে তার হৃদয়ে জমে থাকা কথাগুলো বলতে পারবে - ততদিন এই আন্দোলন-সংগ্রাম চলবে। সেই স্বপ্নের লাল সূর্য উদিত হতে আর বেশি দিন সময় লাগবে না।

আমাদের বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা এবং মানবতা শিশুকাল অতিক্রম করে গেছে বহু আগেই। এখন আর আমরা রূপকথার কল্পিত পরম পিতা নিয়ে মোহিত নই, যে পরম পিতা ‘ডাবের ভেতর জল কেন’ থেকে শুরু করে বিগব্যাং কিংবা ব্ল্যাকহোল পর্যন্ত সবকিছুর পেছনে একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা হিসেবে হাজির হবেন আর আমাদের প্রয়োজনের অলীক ত্রাণকর্তা হিসেবে নিজেকে পরিচিত করাবেন। সময় এগিয়েছে অনেক, আমরা নিজেরাই এখন নিজেদের দায়িত্ব নিতে সক্ষম, মানুষ নিজেই আজ নিজের ভাগ্যবিধাতা। আমরা আর রূপকথার জাল বুনে নিজেদের প্রবোধ দিতে চাই না, বরং বিজ্ঞানের সাম্প্রতিক জ্ঞানের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে এখন জীবন সাজাতে চাই। লেখাটা শেষ করব একজন প্রখ্যাত ব্যক্তির হীরকখণ্ড দিয়ে, “The true atheist will stay silent. To give a theist someone to debate is to harbour his delusion further.” - Charles Darwin.

বিজ্ঞানী লুই পাস্তুর -
পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 25, 2024 | জীবনী | views:293 | likes:0 | share: 0 | comments:0

“আমি সমস্ত জীবন ধরে বিশ্বাস করেছি একমাত্র বিজ্ঞান আর শান্তির চেতনাই পারে সমস্ত অজ্ঞানতা আর যুদ্ধের বিভীষিকাকে দূর করতে। .. বিশ্বাস রাখুন এক দিন সমস্ত দেশই সম্মিলিত হবে যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তি সহযোগিতার পক্ষে আর সেই ভবিষ্যৎ হবে বর্বরদের নয়, শান্তিপ্রিয় মানবজাতির।”



কথাগুলো প্রখ্যাত বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের (Louis Pasteur)। তোমরা কি বিজ্ঞানী লুই পাস্তুরের নাম শুনেছ? তিনি একজন ফরাসি জীববিজ্ঞানী, রসায়নবিদ তথা অণুজীববিজ্ঞানী ও রসায়নবিদ যিনি পাস্তুরায়ন প্রক্রিয়ার আবিষ্কারক, জীবাণুতত্ত্বের প্রবক্তা ও আ্যনথ্রাক্স ও জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কারক হিসেবে ইতিহাসে বিখ্যাত হয়ে আছেন। তার বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলো মানবজাতির ইতিহাসে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে এবং আজও রাখছে।

লুই পাস্তুর ১৮২২ সালের ২৭ ডিসেম্বর ফ্রান্সের জুরা প্রদেশের দোল শহরে জন্মগ্রহণ করেন। বেড়ে ওঠেন আরবোয়া শহরে। তাঁর দরিদ্র পিতা বাবা জাঁ জোসেফ পাস্তুর সেখানকার একটি ট্যানারিতে কাজ করতেন। পাস্তুরের মায়ের নাম জা‍ঁ এটিয়েনেট রোকুই। পাস্তুর বাবা মায়ের তৃতীয় সন্তান ছিলেন।


শৈশবে গ্রামে বেড়ে ওঠা পাস্তুরকে যখন তাঁর পিতা প্যারিসের একটি স্কুলে লেখাপড়া করার জন্য ভর্তি করলেন, তখন কিছুতেই শহরের পরিবেশে তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না। ১৮৩১ সালে পাস্তুরের প্রাথমিক শিক্ষা জীবন শুরু হয়। ছাত্র হিসেবে অত্যন্ত সাধারণ মানের ছিলেন তিনি। পড়াশোনার থেকে আঁকা এবং মাছ ধরাতেই বেশি আগ্রহ ছিল তাঁর। স্কুল শিক্ষা শেষ করে পাস্তুর ১৮৩৯ সালে কলেজে খুব অল্প সময়েই নিজেকে মানিয়ে নিলেন। তাঁর মেধা অধ্যবসায় পরিশ্রম শিক্ষদের দৃষ্টি এড়াল না। স্কুল শিক্ষা শেষ করে পাস্তুর ১৮৩৯ সালে কলেজ রয়্যাল অব বিসানকোন (Collège Royal at Besançon)-এ দর্শন পড়তে ভর্তি হন এবং ১৮৪০ সালে সেখান থেকে স্নাতক হন।  মাত্র ১৮ বছর বয়সে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করে নিজের কলেজেই শিক্ষকতায় যুক্ত হলেন, পাশাপাশি বিজ্ঞানে ডিগ্রি নেওয়ার জন্য পড়াশোনা চালিয়ে যেতে থাকলেন। বিজ্ঞানের বিষয়গুলোর মধ্যে পাস্তুরের প্রিয় বিষয় রসায়ন। চাকরির পাশাপাশি পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন নিয়ে গবেষণাও চালিয়ে যান। ১৮৪৭ সালে তিনি পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের দুটি থিসিস জমা দেন এবং একই বছর দুটি বিষয়েই ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। রসায়নের উচ্চতর শিক্ষায় মনপ্রাণ ঢেলে দিলেন। এরই মধ্যে পাস্তুরের বিজ্ঞানচর্চায় খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল। স্ট্রাসবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে রসায়নের অধ্যাপক পদ গ্রহণের জন্য আহ্বান জানালে তিনি সানন্দে তা গ্রহণ করেন। সেখানেই বিশ্ববিদ্যালয়ের রেক্টরের কন্যা মেরি লরেন্তের সঙ্গে পরিচয়। ২৯ মে ১৮৪৯ সালে তারা বিয়ে করেন। তাঁদের পাঁচ সন্তানের তিনজনই প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগে টাইফয়েডে মারা যায়। এ ঘটনায় মুষড়ে না পড়ে, এর প্রতিকারে মনোনিবেশ করেন পাস্তুর।

স্ত্রী মেরি ছিলেন তাঁর যোগ্য সহচরী, সহমর্মী, সহকর্মী এবং সহধর্মীও বটে। ১৮৫৪ সালে লুই পাস্তুর 'লিলে বিশ্ববিদ্যালয়ে'র বিজ্ঞান বিভাগে ডিন এবং প্রধান অধ্যাপক নিযুক্ত হন। লিলে অঞ্চলে ছিল মদ তৈরির অসংখ্য কারখানা। দীর্ঘদিন উৎপাদিত মদ ভালো রাখতে না পারায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল মালিক এবং সরকার। পাস্তুর গবেষণা করে বের করলেন কী কারণে মদ নষ্ট হয়ে যায়। ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসের জন্য তিনি আবার গবেষণা করতে থাকেন। গবেষণায় সফল হলেন। 


আকৃতি 3 পাস্তুর ও মেরি

তিনি তাঁর গবেষণার মাধম্যে প্রমাণ করে দেখান অ্যালকোহল উৎপাদন ইস্টের পরিমানের উপর নির্ভর করে। তিনি এও প্রমাণ করেন মদের অম্লতার জন্য ব্যাক্টেরিয়াই দায়ী। তৎকালীন সময়ে ফ্রান্সের মদ ব্যবসা মদের অম্লতার কারনে প্রভূত আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হত। পাস্তুর মদের স্বাদ অপরিবর্তিত রেখে ব্যাক্টেরিয়া মুক্ত করার জন্য গবেষণা শুরু করে লক্ষ্য করেন উষ্ণ মদে ব্যাক্টেরিয়া টিকতে পারেনা অথচ মদের স্বাদ অপরিবর্তিত থাকে। পাস্তুর একই পদ্ধতি দুধের ক্ষেত্রেও প্রয়োগ করেন এবং সাফল্য পান। পাস্তুরের আবিষ্কৃত এই এই পদ্ধতি বিশ্বব্যাপী এখন ব্যবহৃত হয় যা 'পাস্তুরায়ন' নামে বিখ্যাত।

পাস্তুর মদে ব্যক্টেরিয়ার উৎস নিয়ে গবেষণা শুরু করেন যখন তখন অনেকের ধারণা ছিল ব্যাক্টেরিয়া নির্জীব বস্তু থেকে নিজে থেকেই জন্ম নেয় যদিও এই মতের বিপক্ষেও অনেকে বিজ্ঞানী ছিলেন। পাস্তুর প্রথম পরীক্ষার মাধ্যমে দেখান, নির্জীব বস্তু থেকে ব্যাক্টেরিয়া বা কোন প্রাণ জন্ম নিতে পারে না। পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত তত্ত্বের সাহায্যে প্রমাণ করেছিলেন জীবাণুমুক্ত নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে প্রাণ কখনোই নিজে থেকে সৃষ্টি হয়না।


পাস্তুরের পরীক্ষা স্বতঃজননবাদকে (Theory of spontaneous generation) ভুল প্রমাণ করেছে। স্বতঃজননতত্ত্বের দাবীদারদের সবাই বিশ্বাস করতেন জটিল জীব তার পূর্ণ অবয়বে নিজে নিজেই ‘সৃষ্টি’ হয়। যেমন, এরিস্টটল বিশ্বাস করতেন কিছু মাছ এবং পতংগের মত ছোট প্রানী স্বতঃস্ফুর্তভাবে উদ্ভূত হয় । ব্রিটিশ গবেষক আলেকজান্দার নীডহ্যাম (১১৫৭-১২১৭) বিশ্বাস করতেন ফার গাছ সমুদ্রের লবণাক্ত জলেতে ফেলে রাখলে তা থেকে রাজহাঁস জন্ম নেয়। জ্যান ব্যাপটিস্ট হেলমন্ট (১৫৮০-১৬৪৪) ভাবতেন ঘর্মাক্ত নোংরা অন্তর্বাস ঘরের কোনায় ফেলে রাখলে তা থেকে ইঁদুর আপনা আপনিই জন্ম নেয়। বিজ্ঞানী পুশে (১৮০০-১৮৭২) বিশ্বাস করতেন খড়ের নির্যাস থেকে ব্যাকটেরিয়া বা অণুজীব স্বতঃস্ফুর্তভাবেই জন্ম নেয়। পাস্তুরের গবেষণা মূলতঃ এই ধরনের ‘সৃষ্টিবাদী’ ধারণাকেই বাতিল করে দেয়। কিন্তু পাস্তুরের পরীক্ষা কিংবা জৈবজনির কোন সূত্রই বলে না যে, প্রাথমিক জীবন জড় পদার্থ থেকে তৈরি হতে পারবে না


ফ্রান্সে এক মহামারীতে রেশম পোকার উৎপাদন হ্রাস পেলে ফরাসি সরকার পাস্তুরকে রেশম শিল্পের এই সমস্যা সমাধানে আহ্বান জানায়। পাস্তুর লক্ষ্য করেন রেশম পোকার এই সমস্যা বংশগত এবং মায়ের থেকে পরবর্তী প্রজন্মে সংক্রামিত হয়। তিনি প্রস্তাব করেন কেবলমাত্র রোগ মুক্ত গুটি বাছাই করার মাধ্যমে একমাত্র রেশম শিল্পকে বাঁচানো সম্ভব।

পাস্তুর তাঁর বিখ্যাত জীবাণু তত্ত্বে (Germ Theory) প্রমাণ করে দেখান কিছু রোগের জন্য অণুজীব দায়ী, যারা জল ও বাতাসের মাধ্যমে সংক্রমিত হয়। তিনি তাঁর জীবাণু তত্ত্বে দেখান অণুজীব বৃহদাকার জীবকেও আক্রমণ করে রোগ সৃষ্টি করতে পারে।

পাস্তুরই প্রথম অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কার করেন। তিনি লক্ষ্য করেন একমাত্র গৃহপালিত পশুর দেহেই অ্যানথ্রাক্স ব্যাসিলি (Bacillus anthrasis)-র আক্রমণে অ্যানথ্রাক্স রোগ সৃষ্টি হয়।

অ্যানথ্রাক্সের টিকা আবিষ্কারের পর পাস্তুর অন্যান্য রোগের প্রতিরোধের জন্য গবেষণা শুরু করেন। তিনি জলাতঙ্ক রোগের ওপর গবেষণা করে দেখেন এই রোগের জীবাণু আক্রান্তের স্নায়ুতন্ত্রকে আক্রমণ করে এবং আক্রান্ত পশুর মেরুদণ্ডের নির্যাসের মাধ্যমে অন্য প্রাণীদেহে জলাতঙ্ক সৃষ্টি করা যায়। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে পাস্তুর রোগ প্রতিরোধে অক্ষম জলাতঙ্ক ভাইরাস সৃষ্টি করেন, যা জলাতঙ্কের টিকা হিসেবে ব্যবহার হয়। ১৮৮৫ সালে পাস্তুর প্রথম এক শিশু বালকের ওপর এই টিকা প্রয়োগ করেন। লুই পাস্তুর কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় দ্বারা আবিষ্কার করেন জলাতঙ্ক রোগের প্রতিষেধক। এই আবিষ্কার তাঁকে বিখ্যাত করে তোলে। ফরাসি অ্যাকাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হলেন তিনি।


লুই পাস্তুর একজন রসায়নের অধ্যাপক হলেও আমৃত্যু কাজ করেছেন অণুজীব নিয়ে। কেমন করে এর উৎপত্তি, কীভাবে এর দ্বারা সমস্যা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায় সেসব নিয়ে। মানবদরদী মহান এই বিজ্ঞানীর কাজ আমাদের জন্য অনুপ্রেরণার এক উজ্জ্বল নিদর্শন।

১৮৯২ সালের ২৭ ডিসেম্বর তাঁকে অভিনন্দন জানাতে প্যারিসে সমবেত হলেন দেশবিদেশের বিজ্ঞানীগণ। সম্মান, উপাধি, পুরস্কার, মানপত্র তাঁর চরিত্র বদলে দেয়নি। তিনি আগের মতোই নিরহঙ্কার, নিরলস, সাদামাটা রয়ে গেলেন। শেষ জীবনে বাইবেল পাঠ আর উপাসনার মধ্যে নিজেকে সমর্পণ করেন। এই বিখ্যাত বিজ্ঞান-সাধক, ১৮৯৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর চিরনিদ্রায় শায়িত হন। মৃত্যুর পর তাঁর দেহ প্যারিসের 'পাস্তুর ইনস্টিটিউটে' স্থানান্তরিত করা হয়। তাঁর মৃত্যুদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতিবছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিশ্ব জুড়ে বিশ্ব জলাতঙ্ক দিবস পালন করা হয়। 

এই মহান বিজ্ঞানীর জন্মদিবসে (২৭ ডিসেম্বর) আমার শ্রদ্ধার্ঘ‍্য।


তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীবনীশতক, বিশ্বের সেরা ১০১ বিজ্ঞানীর জীবনী, রোর মিডিয়া, কালের কণ্ঠ, সব বাংলায়, ইন্ডিয়া টুডে ডট ইন, ফ্রন্টিয়ারসীন ডট ওআরজিও, ব্রিটানিকা ডট কম ও উইকিপিডিয়া।

পাখিপ্রাণ সালিম আলি -
পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 24, 2024 | জীবনী | views:292 | likes:2 | share: 2 | comments:0

১৯৫০ সাল। সুইডেনের উপশালাতে বসেছে পক্ষীবিদদের আন্তর্জাতিক সম্মেলন। প্রথম অধিবেশন শুরু হতে তেমন দেরি নেই, পৌঁছে গিয়েছেন প্রায় সবাই। একজন ভারতীয় অবশ্য তখনও পৌঁছননি। কী হবে? কোথাও আটকে গেলেন নাকি? অনুপস্থিত থাকবেন? এমন ভাবনা যখন ঘুরছে আয়োজকদের মনে তখন হঠাৎ মোটরসাইকেলের গর্জন। একটা সানবীম মডেল ব্রেক কষে দাঁড়াল সভাঘরের বাইরে। নামলেন সেই ভারতীয়। মুহূর্তের মধ্যে খবর চাউর হয়ে গেল যে ভারত থেকে সোজা বাইকে করে উপশালা পৌঁছেছেন এক ভারতীয় পক্ষীবিদ! যার কথা হচ্ছে তিনি সালিম আলি। 

চুয়ান্ন বছর বয়সে ফিল্মি হিরোর মত বাইকে করে আবির্ভূত হতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা নেই যাঁর। এতটাই আকর্ষণ মোটরবাইকের প্রতি যে একটা মডেল নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারতেন না তিনি, শুধু হার্লে-ডেভিডসনেরই তিন রকম মডেল ছিল তাঁর কাছে। এছাড়াও একটা করে ডগলাস, স্কট, নিউ হাডসন এবং জেনিথ মোটরবাইক চালিয়েছেন বিভিন্ন সময়ে। অবশ্য সানবীমের গল্পটা পুরোপুরি সত্যি নয়। ভারত থেকে গোটা পথ ঐ বাইকে পাড়ি দেননি তিনি। বম্বে থেকে জাহাজে করে ইউরোপে আনান বাইকটা, উদ্দেশ্য ছিল সম্মেলনের আগে সেটাতে করে ইউরোপ চক্কর দেওয়া। এই কাজ করতে গিয়ে ফ্রান্সে ছোটখাটো দুর্ঘটনায় পড়লেন, জার্মানীর মসৃন, বাঁধানো রাস্তায় আছাড়ও খেলেন বেশ কয়েকবার। তাতে কী? ভালবাসার জন্য কতকিছু করা যায়, হাত-পায়ে চোট তো সামান্য ব্যাপার। প্রবন্ধের শুরুতে ঝাঁকুনি খেয়ে পাঠক হয়ত প্রশ্ন তুলে ফেলেছেন, সালিম আলি কোনটা বেশী ভালবাসতেন, পাখি না মোটর বাইক? জানা নেই উত্তরটা, তবে বাকি প্রবন্ধ তাঁর পক্ষীপ্রেমের আলোচনায় নিবেদিত।

সালিম আলির পক্ষী-পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা।


যে কোনো শাখার একনিষ্ঠ গবেষক সেই শাখার গভীরতা বুঝতে তার ইতিহাস পাঠ করেন নিবিড়ভাবে। নিজের উপলব্ধি পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। প্রফুল্ল চন্দ্র রায় কাজটা করেছিলেন ‘আ হিস্ট্রি অফ হিন্দু কেমিস্ট্রি’-র মাধ্যমে। সালিম আলি ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনী ও বিভিন্ন বক্তৃতার মঞ্চ। ষোড়শ আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারে সালিম আলি তুলে আনলেন ভারতবর্ষের পক্ষীচর্চার ইতিহাস। মুঘল আমলের আগে পাখিদের বৈশিষ্ট্য বর্ণনার বিক্ষিপ্ত চেষ্টা হলেও সেগুলো নির্ভরযোগ্য নয়। এ ব্যাপারে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু হয় বাবরকে দিয়ে। সালিম আলির মন্তব্য, চালু ধারনাকে আশ্রয় করে পাখির বর্ণনা তৈরি করতেন না সম্রাট বাবর। একটা উদাহরণ - শীতকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মোনাল ফিজ্যান্ট (monal pheasant) নেমে আসে পাহাড়ের পাদদেশে। ওড়ার পথে ফিজ্যান্টের দল যদি কোনো আঙুরক্ষেতের উপর দিয়ে যায়, তখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে যায় সেখানেই। বাবর লিখছেন, ‘এইসব কথার সত্যতা ঈশ্বরই জানেন। আমি বুঝি যে এর মাংস বেশ সুস্বাদু।’ ইতিউতি কথায় যে বাবরের আস্থা নেই এবং পক্ষীকুলের বর্ণনায় যে সেগুলোকে কোনো স্থান দেননি তিনি, এটা তার দৃষ্টান্ত।

তবে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যিনি পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিবিড়ভাবে, তিনি জাহাঙ্গীর। তার সম্পর্কে বলা হয়, সম্রাট না হয়ে তিনি যদি কোনো ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রধান হতেন তবে হয়ত অনেক বেশি সুখী হতেন। এমনই ছিল তার পক্ষীপ্রেম। রাজসভায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ওস্তাদ মনসুর-কে। তাঁর কাজ ছিল নতুন পাখির ছবি আঁকা। জাহাঙ্গীরের আগ্রহ জানতেন তাঁর সাম্রাজ্যের সবাই, এমনকি বিদেশীরাও। তাই নজরানা হিসাবে তারা নিয়ে আসতেন তাদের এলাকার বিশেষ প্রজাতির পাখি। সেগুলো সম্রাটের হাতে পৌঁছনো মাত্রই তিনি মনসুরকে নির্দেশ দিতেন পাখির নিখুঁত ছবি আঁকতে। 

সৌভাগ্যক্রমে, এর মধ্যে বেশ কিছু ছবি আজও সংরক্ষিত রয়েছে। কলকাতার ভারতীয় যাদুঘরেও সম্ভবত রয়েছে তার নমুনা। ছবির পাশাপাশি পাখির চেহারা, বাসস্থান এবং আনুষঙ্গিক বিষয়ের বিস্তারিত বিবরণ তৈরি করতেন জাহাঙ্গীর।

সেইসব বর্ণনা ধরা রয়েছে তাঁর স্মৃতিকথায়। ১৬২৪ পর্যন্ত চলে জাহাঙ্গীরের স্মৃতিকথা রচনা। এই সময়ের মধ্যে কত যে পাখির বৈজ্ঞানিক বর্ণনা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। সালিম আলি জানিয়েছেন যে তাঁর দরবারে ডোডো পাখিও পৌঁছেছিল। তবে সেটা ১৬২৪ সালের পরে। ফলে সেটার ছবি থাকলেও স্মৃতিকথায় কোনো উল্লেখ নেই।

জাহাঙ্গীরের সাম্রাজ্য বা আরো পরে মুঘল সাম্রাজ্য ছারখার হওয়ার পরে সম্রাটের সংগৃহীত বহু নমুনা বিশ্বের কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পড়ে। স্রেফ লুটের খেলা চলছিল তখন। যিনি পাখির নমুনা চুরি করছেন, তিনি হয়ত জানেনও না তার গুরুত্ব। লুটেরাদের দলে অবশ্যই ছিল ব্রিটিশরা। কিন্তু তাঁদের অপরাধের পাশাপাশি গুণপনাও কিছু কম ছিল না। ব্রিটিশ রাজপুরুষদের অনেকেরই আগ্রহ ছিল পাখিদের সম্পর্কে তথ্যভান্ডার গড়ে তোলায়। সেদিক থেকে দেখতে গেলে ভারতে প্রথম পাখি সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক সংকলন তৈরী করেছিলেন ব্রিটিশ সাহেব জার্ডন। ১৮৬২ এবং ১৮৬৪ সালে তিনি প্রকাশ করেন ‘বার্ডস অফ ইন্ডিয়া’-র দুটো খন্ড। এর পরে যে খামতি ছিল তা পূরণ করেন দুজন ভারতীয় - সালিম আলি এবং সিডনি ডিলো রিপলে। দশ খন্ডে তাঁরা প্রকাশ করেন ‘হ্যান্ডবুক অফ দ্য বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’। প্রকাশকাল ১৯৬৮ থেকে ১৯৭৩। এতগুলো খন্ড প্রকাশের পরও, যে বিষয়টা সালিম আলিকে চির-অতৃপ্ত রেখেছিল তা হল পাখিদের স্থানীয় নামের নির্ভরযোগ্য তালিকা সম্পূর্ণ করতে না পারা। এর অভাবে জনপ্রিয় বই যে তৈরী করা মুশকিল তা বিলক্ষণ জানতেন তিনি।

জনপ্রিয়করণের এই আগ্রহ যে সারা জীবন তাঁর মধ্যে ছিল, তার বহু প্রমাণ ছড়িয়ে রয়েছে। পরিণত বয়েসে একবার তিনি প্রতিষ্ঠিত পক্ষীবিদ রিপলেকে বেশ রাগ করেই লেখেন যে পক্ষীচর্চার সবটাই যদি কাঠ-কঠিন নামকরণের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে তিনি ছেড়েই দেবেন বিষয়টা। অরণ্যে পাখিদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ অধ্যয়ন ছেড়ে তিনি এমন ট্যাক্সোনমির যুদ্ধ করতে আগ্রহী নন। মজার কথা, প্রাণীবিজ্ঞানে সালিম আলির প্রশিক্ষণ মাত্র এক বছরের। ১৯১৭ সালে দুটো কলেজে একসাথে ভর্তি হন তিনি। একটাতে পড়াশোনার বিষয় ছিল আইন ও হিসাবশাস্ত্র। অন্যটাতে প্রাণীবিজ্ঞান।

দুটোই সম্পূর্ণ করেন তিনি। অবশ্য শুধু সময়ের ‘দৈর্ঘ্য’ দিয়ে এই সময়টাকে মাপলে চলবে না। এই সময়েই তিনি যুক্ত হতে শুরু করেন বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির সঙ্গে। তার কেরিয়ার গঠিত হতে শুরু করে এই জায়গা থেকে। তবে ওই সোসাইটির সঙ্গে তার প্রথম পরিচয় যে নিতান্ত শৈশবে, তা তো পাঠক মাত্রেই জানেন। ঘটনাটা এইরকম। একটা চড়ুই পাখি মেরেছিল ছোট্ট সালিম, তাঁর খেলনা এয়ারগান দিয়ে। সোসাইটির সম্পাদক মিলার্ড সাহেব সেই পাখি দেখে আগ্রহ প্রকাশ করলেন। পাখির শরীরে ব্যতিক্রমী রঙের বিস্তার দেখে মনোযোগী হলেন তিনি। চিহ্নিত করলেন পীত্কন্ঠ চড়ুই হিসাবে। এরপরে, বলা যায় পুরস্কার হিসাবে, সোসাইটির stuff করা পাখির সংগ্রহ দেখালেন। এই বিশেষ চড়ুইয়ের কথা সালিম আলি লিপিবদ্ধ করেছেন তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ আ স্প্যারো’ তে। মৃত চড়ুই তাঁকে পাখির জগতের দরজা দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছিল।

বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রির সঙ্গে তাঁর যোগ যে কতটা নিবিড় ছিল তা বোঝাতে ১৯৮৩ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর তারিখের নিউ সায়েন্টিস্ট পত্রিকা থেকে উদ্ধৃত করব। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘বায়োলজি আন্ডার দ্য রাজ’। সোসাইটির শতবর্ষ পূর্তিতে এর ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে এক জায়গায় লেখা হয়েছে (অনুবাদ):-

“১৯৩০ থেকে বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটির কাহিনী নির্ধারিত হয়েছে সালিম আলি নামে এক ক্ষীণদেহীর দ্বারা। কোনো ডিগ্রী নেই, জীববিজ্ঞানের প্রশিক্ষণও দূর অস্ত, তিনি বার্মায় কাঠ ব্যবসায়ীর পেশা ছেড়ে নিজের জীবন নিয়োজিত করেন পক্ষীচর্চায়। আজ ৮৭ বছর বয়সেও তিনি সমান সক্রিয় এবং দেশে বিদেশে সোসাইটির সঙ্গে তাঁর নাম সমার্থক। তাঁর ভূমিকার তাৎপর্য দুরকম: প্রকৃতিবিদ হিসাবে এবং প্রশাসক রূপে। যদিও প্রানীদের সমীক্ষার সাথে মূলত যুক্ত ছিলেন তিনি, প্রান্তরে-অরন্যে গিয়ে প্রাণীর আচরণ ও বাস্তুতন্ত্রের সংস্কারমুক্ত, সরল পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ইতিহাস চর্চার প্রতি এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে তোলেন। বিশেষ করে বাবুই পাখির সামাজিক জীবন সম্পর্কে তাঁর গবেষণা, মুক্ত ভাবনা এবং স্পষ্টতার দিক দিয়ে কিছু বছর আগে great crested grebes এর উপর জুলিয়ান হাক্সলির করা গবেষণার সঙ্গে তুলনীয়।”

প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সালিম আলি ভরতপুরকে চাষের ক্ষেতে পরিবর্তিত হওয়া থেকে বাঁচান। 


তবে সোসাইটির পুরোভাগে থাকাকালীন কিছু বিতর্কেও জড়িয়ে পরেন তিনি। স্বাধীনতার পরে যখন রাজস্থানের ভরতপুরে মহারাজার অধীনে থাকা কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি ভেঙেচুরে চাষের ক্ষেত বানানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করে, তখন তিনিই প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাঁচান ভরতপুরকে। অবশ্য মহারাজার শিকারের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রজননের ঋতুতে শিকারের উপর নিষেধাজ্ঞা পড়ে। পাখির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে যেতেও দ্বিধা করেননি তিনি। অবশ্য নেহাৎ আবেগের বশে একাজে লিপ্ত হননি সালিম আলি। তিনি দেখান যে ভরতপুর পার্শ্ববর্তী এলাকাকে দেয় অনেক কিছু - গবাদি পশুর খাবার, জ্বালানি কাঠ, ফল এবং বাড়ির ছাউনির জন্য খড় ইত্যাদি। চাষের ক্ষেত তৈরি হলে এর থেকে বেশি উপকৃত যে নাগরিকরা হবেন না, তা বোঝে সরকার। পাশ হয় ভরতপুরের অরণ্য ও জলাভূমি অটুট রাখার সিদ্ধান্ত।

এই ভরতপুরকেই ন্যাশনাল পার্ক করার আগ্রহ দেখান সালিম আলি। এই আগ্রহের সঙ্গে যুক্ত হয় দাবি - গবাদি পশুকে ঢুকতে দেওয়া যাবে না এই এলাকায়। কিন্তু ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে সোসাইটির করা এক সমীক্ষায় দেখা যায় যে গবাদি পশু না ঢুকলে এক বিশেষ ধরেণের আগাছা বাড়ছে হু হু করে। এরা জলের মধ্যে মাছের জীবনকেও সীমিত করে দিচ্ছে। ফলে মাছের সংখ্যা কমছে এবং সঙ্গে-সঙ্গে কমে যাচ্ছে জলের পাখি। এই সমীক্ষায় সহযোগী হয় ইউনাইটেড স্টেট্স ফিশ অ্যান্ড ওয়াইল্ড লাইফ সার্ভিস। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড চালিনর ১৯৮০ সালে আসেন এই সমীক্ষায় অংশ নিতে। হতবাক হয়ে তিনি চিঠি লেখেন রিপলেকে। রিপলে বিষয়টা নিয়ে লেখেন সালিম আলিকে। 

তবে সোসাইটির পুরোভাগে থাকাকালীন কিছু বিতর্কেও জড়িয়ে পড়েন তিনি। স্বাধীনতার পর যখন রাজস্থানে ভরতপুরের মহারাজার অধীনে থাকা কেওলাদেও ঘানা বার্ড স্যাংচুয়ারি ভেঙেচুরে চাষের ক্ষেত বানানোর জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের নেতৃত্বে স্থানীয় মানুষ আন্দোলন শুরু করেন তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে বাঁচান ভরতপুরকে। অবশ্য মহারাজার শিকারের স্বাধীনতা সীমাবদ্ধ করে দেওয়া হয়। প্রজনন ঋতুতে শিকারে নিষেধাজ্ঞা পড়ে, পাখির জন্য এলাকার সাধারণ মানুষদের বিরুদ্ধে যেতে তিনি দ্বিধাবোধ করেননি। অবশ্য শুধু আবেগের বশে এ কাজে লিপ্ত হননি সালিম, তিনি দেখান যে ভরতপুর পার্শ্ববর্তী এলাকাকে অনেককিছু দেয়-গবাদি পশুর খাবার, জ্বালানি কাঠ, ফল এবং বাড়ির ছাউনির জন্য খড় ইত্যাদি। চাষের ক্ষেত তৈরি হলে এর থেকে বেশি উপকৃত যে নাগরিকরা হবেন না, তা বুঝে সরকার পাস করে ভরতপুরের অরণ্য এবং জলাভূমি অটুট রাখার সিদ্ধান্ত। ভরতপুরকে ন্যাশনাল পার্ক করার আগ্রহ দেখান সালিম। এই আগ্রহর সঙ্গে যুক্ত হয় বিভিন্ন দাবি যেমন, গবাদি পশু প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ইত্যাদি। কিন্তু সোসাইটির এক সমীক্ষায় দেখা যায় গবাদি পশু ঢুকতে না দিলে আগাছার সংখ্যা প্রচুর পরিমাণে বেড়ে যাচ্ছে যা জলের মধ্যে মাছের জীবনকেও সীমিত করে দিচ্ছে। এই সমীক্ষায় সহযোগী হয় ইউনাইটেড স্টেটস ফিশিং অ্যান্ড ওয়াইল্ডলাইফ সার্ভিস। স্মিথসোনিয়ান ইনস্টিটিউশনের বিজ্ঞান বিভাগের সহকারী সচিব ডেভিড ১৯৮০ সালে ভারতে আসেন এই সমীক্ষা তদারকি করতে। তিনি গবাদি পশুর অবাধ বিচরণের পক্ষে রায় দেন। প্রায় এক দশক ধরে চলা বিতর্কের পর ১৯৯১ সালে প্রকাশিত হয় সোসাইটির প্রতিবেদন। তখন সালিম এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ক্রমেই গবাদি পশুর জন্য ভরতপুরের পাখিদের দৈন্যদশা প্রকট হতে শুরু করেছে।

১৯০৬/০৭ বাইরে পুরুষ চড়াইটি কাঠের গোঁজে বসে আছে। গর্তের প্রবেশপথের প্রায় মুখে। ভেতরে স্ত্রী চড়াই ডিমে তা দিতে বসেছে। আস্তাবলের কাছে একটি ঘোড়ার গাড়ির পেছনে নিজেকে আড়াল ক’রে অতর্কিতে আমি তাদের উপর আক্রমণ করলাম। পুরুষ চড়াইটা গুলি খেয়ে মরল। কিছুক্ষণ যেতে না যেতে দেখি মেয়েটি এক ফাঁকে আরেকটি পুরুষ-চড়াই জুটিয়ে এনেছে। সেও বাইরের গোঁজটাতে ভর দিয়ে ‘পাহারা’য় বসে গেছে। এই মরদটিকেও আমি ঘায়েল করলাম। চোখের পলকে দেখি মেয়েটি আবার এক মরদ এনে হুজুরে হাজির করেছে। পরের সাত দিনে ঐ একই দাঁড়ে-বসা গুটি আষ্টেক পুরুষ চড়াইকে আমি সাবাড় করি।...’

নয়-দশ বছর বয়সে এই কথাগুলো ডায়েরিতে লিখেছিলেন সেলিম আলি! উনিশ শতকের প্রথম দিকে ভারতীয়দের কাছে ‘পক্ষী সংরক্ষণ’ ব্যাপারটা ছিল কল্পনাতীত। বরং পশুপাখি শিকারে যে যত কামাল দেখাতে পারবে সে তত বড় পুরুষসিংহ। শিকার-শিকার খেলতে খেলতেই সেলিম হয়েছিলেন বার্ডম্যান অব ইন্ডিয়া।

মাত্র তিন বছর বয়সে সেলিম মা-বাবাকে হারান। অনাথ হয়েও পাঁচ ভাই ও চার বোনের সঙ্গে সেলিম নিঃসন্তান মামা-মামির কাছে বড়ই আদরে মানুষ হয়েছিলেন। মামা আমিরউদ্দিন ছিলেন বড় শিকারি। সাহেবরা তাঁকে নেকনজরে দেখতেন। নয় বছরের ছোট্ট সেলিমকে তিনি একটি এয়ারগান উপহার দিয়েছিলেন। ছোট থেকেই মাসে ২ টাকা হাতখরচ পেতেন সেলিম। সেই টাকা জমিয়ে মুম্বইয়ের ক্রফোর্ড মার্কেটের পাখির বাজার থেকে নানা ধরনের পাখি কিনে, তারের জাল ও প্যাকিং বাক্স জুড়ে খাঁচা বানিয়ে তাতে পাখিগুলিকে রাখতেন। এমনও হয়েছে, বাড়িতে মেহমানদের জন্য বস্তাবন্দি তিতির বা বটের পাখি এসেছে। সে সব সুস্বাদু পদ হওয়ার আগেই বস্তা খুলে জ্যান্ত পাখি চুপিসারে সরিয়ে ফেলতেন। সেই সব পাখিদের জায়গা হত খাঁচায়। 

বড়দের অলক্ষে খুদেদের এই সব কাজে সাহায্য করত বাড়ির পুরনো ভৃত্য নান্নু। আত্মজীবনী ‘ফল অব আ স্প্যারো’-তে সেলিম লিখেছেন, তিনি বেশি দিন বাঁচিয়ে রাখতে পারতেন না খাঁচার বন্দি পাখিগুলিকে। তার পরেই হাতে আসে এয়ারগান। সেলিমের বাড়ির ভিতরে ছাদে বারান্দায় ছিল অগুনতি চড়াইয়ের বসবাস। চোখের সামনে এত চড়াই ছিল প্রশিক্ষণের জন্য মোক্ষম। তিনি জেনে নিয়েছিলেন, মুসলমান সন্তান হিসেবে চড়াইয়ের মাংস গ্রহণে পাপ নেই। কিন্তু তা উপযুক্ত হালাল হওয়া চাই। মৃত চড়াইকে হালাল করার পদ্ধতি, কী ভাবে তেল মশলা দিয়ে এদের সদগতি করতে হবে, সবই শিখেছিলেন নান্নুর কাছেই! 

এমনই এক দিন, শিকারের পর এক চড়াইপাখি হালাল করতে গিয়ে তার চোখ আটকে গেল পাখির গলায়। এ তো ঠিক পরিচিত চড়াইয়ের গলার মেটে দাগ নয়। তা হলে? মৃত পাখিটির গলায় ঝোল পড়ার দাগের মতো হলদে ছাপ। হালাল না করে মৃত পাখিটিকে নিয়ে গেলেন মামার কাছে। মামাও এর বিহিত করতে না পারায় একটি চিঠি লিখে পাঠিয়ে দিলেন ‘বম্বে ন্যাচারাল হিস্ট্রি সোসাইটি’র তৎকালীন অবৈতনিক সেক্রেটারি ডব্লু এস মিলার্ড-এর কাছে। সোসাইটির ভিতরে দেওয়াল জুড়ে মাউন্ট করা জীবজন্তু, শো কেসে সাজানো প্রজাপতি ও পাখির ডিম, দেওয়ালে টাঙানো চিতাবাঘ-বাঘের মাথার খুলি... প্রথম বার এই সব দেখে সেলিমের ছোট্ট মনে একরাশ বিস্ময় তৈরি হয়। তৈরি হয় কৌতূহল। সেই কৌতূহলই সেলিমের জীবন বদলে দিয়েছিল। প্রথম দিনের এই অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে সেলিম আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘এটা নিশ্চয় ১৯০৮ সালের কোনও একটা সময়ে ঘটে থাকবে। বি এন এইচ এস-এর সঙ্গে সেই আমার প্রথম যোগাযোগ। পরে আমার জীবন গড়ে তুলতে এবং বিশেষ একটি খাতে বইয়ে দিতে এই যোগাযোগ বড় রকমের সাহায্য করেছিল।’

পাখি ও প্রকৃতির বাইরে সেলিম আলি পাগল ছিলেন আর একটি ব্যাপারে। সেটি হল মোটরসাইকেল! কাজের সূত্রে মায়ানমারে গিয়ে প্রথম তাঁর হাতে আসে মোটরসাইকেল, ‘জেনিথ’। ‘হার্লে ডেভিডসন’, ‘ডগলাস’, ‘স্কট’, ‘নিউ হাডসন’ এবং ‘মেক’... সেরা কোম্পানিগুলির মোটরসাইকেল ব্যবহার করেও তাঁর আমৃত্যু আফসোস ছিল বিএমডব্লু-র মোটরসাইকেল ব্যবহার করার সুযোগ পাননি বলে! বছর-বছর মোটরসাইকেলের ইঞ্জিনে কোথায় কী নকশা বদলাল, তা জানার জন্য তিনি মুখিয়ে থাকতেন। কৌতূহল মেটাতেন মোটরবাইক সংক্রান্ত বিভিন্ন জার্নাল আর প্রস্তুতকারকদের ক্যাটালগ পড়ে। নতুন মোটরসাইকেল হাতে এলেই, তিনি তার ইঞ্জিন খুলে বোঝার চেষ্টা করতেন, কোম্পানি নতুন কী যন্ত্রপাতি তাতে দিল এবং কেন দিল। সপ্তাহান্তে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় দিতেন মোটরসাইকেলের ভিতর ও বাইরে পরিষ্কার করতে।

১৯৫০-এ সুইডেনে আন্তর্জাতিক পক্ষিতাত্ত্বিক কংগ্রেস-এ তিনি একমাত্র ভারতীয় প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন। সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় বাইক ‘সানবিম’। একটাই উদেশ্য, ওই বাইকে করে গোটা ইংল্যান্ড চষে বেড়ানো। তাঁর স্বপ্ন সফল হয়েছিল।

সালিম আলি সারা জীবন নিজেকে দেখেছেন একজন শখের বা অ্যামেচার পক্ষীবিদ হিসাবে। অথচ তিনিই তৈরি করে দিয়ে গিয়েছেন পেশাদারিত্বের সুউচ্চ মান। বিজ্ঞানী মাধব গ্যাডগিল-এর মতে তাঁর পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর ও জাহাঙ্গীরের মত - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠা বজায় রাখা। 

হয়ত আবেগের বশে কোথাও-কোথাও তিনি কিঞ্চিৎ সরে গিয়েছেন যুক্তির নিগড় থেকে। তবে তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে সবসময় ছিল পাখিদের সংরক্ষণ। কেবল সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি নয়, নিখাদ অর্থনৈতিক মূল্যে পাখি যে কত দামী তা বুঝতেন তিনি, বুঝিয়ে গিয়েছেন আমাদের।

ঝুলি ভর্তি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি না থাকলেও ঝুলি ভরে গেছিল সম্মানে। ১৯৫৩ সালে তিনি এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল কর্তৃক প্রদত্ত জয় গোবিন্দ গোল্ড মেডেল লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন পরবর্তীকালে ১৯৭৩ সালে দিল্লি ইউনিভার্সিটি এবং ১৯৭৮ সালে অন্ধ্র ইউনিভার্সিটিও তাঁকে একই সম্মানে ভূষিত করে। ১৯৬৭ সালে তিনিই হন প্রথম অব্রিটিশ মানুষ, যিনি ব্রিটিশ অর্নিথলজিস্ট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে গোল্ড মেডেল লাভ করেন। সেই বছরই তিনি জ্য পল ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশনের পক্ষ থেকে ১০ লক্ষ ডলারের পুরস্কার পান, যা তিনি নিজের নামের একটি বার্ড কনজারভেশন ফান্ডকে দান করে দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি জন সি ফিলিম মেমোরিয়াল মডেল পান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অফ কনজারভেশন অফ নেচার অ্যান্ড নেচার রিসোর্সের পক্ষ থেকে। ইউএসএসআর অ্যাক্যাডেমি অফ মেডিক্যাল সায়েন্স তাঁকে প্যাভলস্কি সেন্টিনারি মেমোরিয়াল মেডেলে ভূষিত করে। সেই বছরই তিনি কমান্ডার অফ নেদারল্যান্ডস সম্মানে ভূষিত হন, সেই দেশের যুবরাজ বার্নার্ডের দ্বারা। ভারত সরকার তাকে হাজার ১৯৫৮ সালে পদ্মভূষণ এবং ১৯৭৬ সালে পদ্মবিভূষণ সম্মানে ভূষিত করেন। ১৯৮৫ সালে তিনি রাজ্যসভার সাম্মানিক সদস্য রূপেও মনোনীত হন।


সালিম মূলত উইভার নিয়ে গবেষণা করছিলেন। লেখালেখির কাজ করার জন্য তিনি বেছে নেন তাঁর শ্বশুরবাড়িকেই। তাঁর শ্বশুরবাড়ি ছিল মুম্বইয়ের একটি ছোট্ট গ্রাম কিহিমে। গাছপালায় ঢাকা শান্ত পরিবেশের সেই গ্রামে একমনে কাজ চালিয়ে যেতে থাকেন সালিম। ১৯৩০ সালে তিনি প্রকাশ করেন উইভার গোত্রের পাখিদের বৈশিষ্ট্য এবং কার্য পদ্ধতি নিয়ে লেখা তাঁর প্রথম আর্টিকেল। এই আর্টিকেল তাঁকে পক্ষীবিশারদ মহলে একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে জায়গা করে দেয়। এই সময়ের পর থেকেই সালিম ঘরে বসে গবেষণার বদলে সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে ঘুরে পাখিদের সম্পর্কে সার্ভে এবং বিশদ গবেষণা চালাতে শুরু করেন। দশ বছরের দীর্ঘ গবেষণার পর তিনি প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত ‘দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস।’ এরপরে তিনি অপর এক বিখ্যাত পক্ষীবিদ এস ডিলন রিপ্লের সঙ্গে যৌথভাবে ১০ খণ্ডের ‘হ্যান্ডবুক অফ দ্য বার্ডস অফ ইন্ডিয়া অ্যান্ড পাকিস্তান’ প্রকাশ করেন। যেটা করতে তিনি প্রায় ১০ বছর সময় নিয়েছিলেন। এখানে তিনি আরও গভীরভাবে উপমহাদেশীয় পাখিদের গঠন, চালচলন, বাসস্থান, প্রজনন, পরিগমন ইত্যাদি নানান ব্যাপারে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ তুলে ধরেছেন। এছাড়াও তাঁর লেখা অন্যান্য বইয়ের মধ্যে রয়েছে ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত ‘কমন বার্ডস’ এবং ১৯৮৫ সালে লেখা তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য ফল অফ স্প্যারো।’

সালিম আলি পক্ষী পর্যবেক্ষণের কৌশল ছিল মুঘল সম্রাট বাবর এবং জাহাঙ্গিরের মতোই - দ্রুত ধারণা তৈরি করা কিন্তু যুক্তিনিষ্ঠ বজায় রাখা। যেকোনও শাখার একনিষ্ঠ গবেষক সেই শাখার গভীরতা বুঝতে তার ইতিহাস পাঠ করেন নিবিড়ভাবে নিজের উপলব্ধি পৌঁছে দেন সাধারণ মানুষের কাছে। সালিম আলি ব্যবহার করেছেন তাঁর লেখনী ও বিভিন্ন বক্তৃতার মঞ্চে। ষোড়শ আজাদ মেমোরিয়াল লেকচারে সালিম আলি তুলে আনলেন ভারতবর্ষের পক্ষী চর্চার ইতিহাস। মুঘল আমলের আগে পাখির বৈশিষ্ট্য বর্ণনা বিক্ষিপ্ত চেষ্টা হলেও সেগুলি নির্ভরযোগ্য ছিল না। এ ব্যাপারে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক চেষ্টা শুরু করেন বাবর। এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সালিম বলছেন, “চালু ধারণাকে আশ্রয় করে পাখির বর্ণনা তৈরি করতেন সম্রাট বাবর একটা উদাহরণ দেওয়া যায়, শীতকালে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মোনাল ফিজ্যান্ট নেমে আসে পাহাড়ের পাদদেশে পথে এদের দল যদি কোনও আঙুর ক্ষেতের উপর দিয়ে যায়, তখন চলচ্ছক্তিহীন হয়ে পড়ে সেখানেই।” বাবর লিখেছেন, ”এইসব কথার সত্যতা ঈশ্বরই জানেন। আমি বুঝি যে এর মাংস বেশ সুস্বাদু। ‘ইতিউতি কথায় যে বাবরের আস্থা নেই এবং পক্ষীকুলের বর্ণনার যে সেগুলোকে কোনও স্থান দেননি, এটাই তার দৃষ্টান্ত। তবে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে যিনি পাখি সম্পর্কিত জ্ঞানের ভাণ্ডার গড়ে তুলেছিলেন নিবিড়ভাবে তিনি হলেন সম্রাট জাহাঙ্গির। তাঁর সম্পর্কে বলা হয়, তিনি যদি সম্রাট না হয়ে কোনও ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রধান হতেন, তাহলে হয়তো অনেক বেশি সুখী হতেন। এমনই ছিল তাঁর পক্ষীপ্রেম। রাজসভায় তিনি স্থান দিয়েছিলেন বিখ্যাত চিত্রকর ওস্তাদ মনসুরকে। তাঁর কাজ ছিল নতুন পাখির ছবি আঁকা। 

বিখ্যাত পক্ষীবিশারদ ছাড়াও তিনি ছিলেন এক বাইক পাগল মানুষ। তাঁর জীবনের প্রথম গাড়ি ছিল ৩.৫ এইচ পি এনএসইউ। পরবর্তীকালে একটি সানবিম এবং তিনটি আলাদা আলাদা মডেলের হার্লে ডেভিডসন, একটি ডগলাস, একটি স্কট একটি নিউহাডসন এবং একটি জেনিথ তাই বাইকের সংগ্রহশালাকে শোভান্বিত করেছিল।

১৯৯০ সালের ভারত সরকারের তত্ত্বাবধানে কোয়েম্বাটুরে সালিম আলি সেন্টার ফর অর্নিথলজি অ্যান্ড ন্যাচারাল হিস্ট্রি প্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠিত হয়। পন্ডিচেরি ইউনিভার্সিটিতে স্থাপন করা হয় সালিম আলি স্কুল অফ ইকোলজি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স। গোয়া সরকার প্রতিষ্ঠা করেন সালিম আলিবার্ড স্যাংচুয়ারি এবং এবং কেরালাতে ভেম্বানাদের কাছাকাছি এক জায়গায় তাঁর সম্মানে সূচনা ঘটে থাট্টাকাড বার্ড স্যাংচুয়ারি। ১৯৭২ সালে কিট্টি থংলঙ্গা একটি বিরল প্রজাতির বাদুড়ের স্পিসিজ আবিষ্কার করেন যার নাম রাখা হয় Latidens salimalii. এছাড়াও রক বুস কোয়েলের একটি সাব স্পিসিসকেও তাঁর নামেই Perdicula argoondah salimalii পরিচিতি দেওয়া হয়। এছাড়াও ফিন-এর উইভারের একটি প্রাচ্যীয় সাব স্পিসিসকেও নাম রাখা হয় তাঁরই নামে Ploceus megarhynchus salimalii. ব্ল্যাক-রাম্পড ফ্লেম ব্যাক উডপেকারের একটি সাব স্পিসিসকে নাম রাখা হয় তাঁর স্ত্রীর নামে (তেহমিনা) Dinlopium benghalenese tehmainae.

১৯৮৭ সালের ২০ জুন প্রোস্টেট ক্যানসারের সঙ্গে দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের পর ৯০ বছর বয়সে তিনি জীবনযুদ্ধে হার মানেন এবং আমাদের ছেড়ে অন্য জগতে পাড়ি দেন। এরকম মানুষের শুরু তো আছে, কিন্তু তার যেন শেষ নেই। তাঁর সম্পর্কে যতই বলা হোক না কেন, তা যেন কম পড়ে যায়। 

ভারতের বার্ডম্যান সেলিম আলি। পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমের বাইরে তাঁর খুব প্রিয় ছিল মোটরসাইকেল। এই নভেম্বরে তাঁর ১২৬-তম জন্মদিবস। আমার শ্রদ্ধার্ঘ্য।


★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার :- (১) ডঃ মানস প্রতিম দাস, অনুষ্ঠান কার্যনির্বাহক, আকাশবাণী কলকাতা, আকাশবাণী ভবন, (২) বিজ্ঞান ডট ওআরজি ডট ইন, (৩) ঊর্মি নাথ, (৪) আনন্দবাজার পত্রিকা, (৫) বিজ্ঞান পত্রিকা - কিছু ইতিহাস-কিছু বিজ্ঞান, ১৩ নভেম্বর ২০১৫, (৬) পক্ষীবিশারদ সালিম আলি - রেজা খান। (৭) ফেমাস সাইন্টিস্টস - সালিম আলি ১৮৯৬-১৯৮৭, (৮) ফল অফ স্প্যারো - সালিম আলি, (৯) দ্য বুক অফ ইন্ডিয়ান বার্ডস - সালিম আলি, (১০) দ্য হিন্দু - হাইড অ্যান্ড সিক উইথ সালিম আলি, ১১ নভেম্বর ২০১৭, (১২) ইন্ডিয়া টুডে - রিমেম্বারিং সালিম আলি : দ্য বার্ড ম্যান অফ ইন্ডিয়া, (১১) মাই সেপিক ডট কম ও (১৩) উইকিপিডিয়া।

★ পাখী সংক্রান্ত কয়েকটি সুন্দর ওয়েবসাইট :- Bird Count India, eBird, eBird India, Cornell Lab of Ornithology, Audubon Society.

‘মেঘনাথ’ থেকে ‘মেঘনাদ’ -
পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 23, 2024 | জীবনী | views:9742 | likes:3 | share: 2 | comments:0

হিন্দু ধর্মের গোঁড়ামির প্রতি বিদ্বেষে নিজের নাম বদলে ফেলেছিলেন মেঘনাদ সাহা।

আজ ভারতীয় বিজ্ঞান সাধনার পথিকৃত মেঘনাদ সাহার ১২৯ তম জন্ম বার্ষিকী। তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে ‘তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব’ প্রতিষ্ঠাতা করেন। তার আবিস্কৃত ‘সাহা আয়নীভবন সমীকরণ’ নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মগুলো ব্যাখ্যা করতে অপরিহার্য।

শুধু ভারতীয় উপমহাদেশে নয় - সমগ্র বিজ্ঞানের জগতে আধুনিক জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছে যে ক’জন মানুষের মৌলিক তত্ত্বের ওপর - অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা তাঁদের অন্যতম।

 ১৯২০ সালে মেঘনাদ সাহার ‘তাপীয় আয়নায়নের সমীকরণ’ (আয়নাইজেশান ইকুয়েশান) প্রকাশিত হবার পর থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানে যত গবেষণা হয়েছে তাদের প্রায় সবগুলোই সাহার সমীকরণ দ্বারা প্রভাবিত। নরওয়ের বিখ্যাত জ্যোতিঃপদার্থবিজ্ঞানী সেভিন রোজল্যান্ড অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত তাঁর বিখ্যাত ‘থিওরেটিক্যাল এস্ট্রোফিজিক্স’ বইতে স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছেন এ’কথা। আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের পারমাণবিক তত্ত্ব থেকে শুরু করে বিগ-ব্যাং তত্ত্বের পরীক্ষণ পর্যন্ত সহজ হয়ে উঠেছে যে যন্ত্রের উদ্ভাবনের ফলে - সেই সাইক্লোট্রনের উদ্ভাবক নোবেল বিজয়ী আর্নেস্ট লরেন্স সহ অসংখ্য বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অর্জন করেছেন মেঘনাদ সাহা তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। নোবেল বিজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী আর্নল্ড সামারফেল্ড, নীল্‌স বোর, ম্যাক্স বর্ন, আলবার্ট আইনস্টাইন, আর্থার এডিংটন, এনরিকো ফার্মি, আর্থার কম্পটন প্রমুখ দিকপাল মুগ্ধতার সাথে স্বীকার করেছেন মেঘনাদ সাহার অনন্য প্রতিভার কথা। ভারতবর্ষের বিজ্ঞানচর্চার সাথে বিশ্বের পরিচয় ঘটিয়ে দেয়ার ব্যাপারে এবং ভারতের বিজ্ঞান-গবেষণাকে বিশ্বমানে উন্নীত করার ব্যাপারে মেঘনাদ সাহার অবদান অনস্বীকার্য।

গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পাবার পাশাপাশি মেঘনাদ সাহা নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন চার বার। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশ্বমাপের বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার অক্লান্ত পরিশ্রমে। দেশে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞান পড়ানো শুরু হয়েছে মেঘনাদ সাহার হাতে। নিরলস চেষ্টা ও পরিশ্রমে গড়ে তুলেছেন ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার ফিজিক্স। ন্যাশনাল একাডেমি অব সায়েন্স, ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি, ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ এসোসিয়েশান - সবগুলো সংগঠনই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মেঘনাদ সাহার নেতৃত্বে। বাংলাদেশ ও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের প্রায় সবাই মেঘনাদ সাহার ‘টেক্সট বুক অব হিট’ বইটা পড়েছেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে মেঘনাদ সাহা মূলত পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র ছিলেন না। তিনি বিএসসি ও এমএসসি পাশ করেছেন মিশ্র গণিতে। সম্পূর্ণ নিজের চেষ্টায় পদার্থবিজ্ঞান শুধু শিখেছেন তাই নয় - ক্রমশঃ পৌঁছে গেছেন এই বিষয়ের শিখরে। 

উপমহাদেশে প্রথম সাইক্লোট্রন স্থাপিত হয় মেঘনাদ সাহার প্রচেষ্টায়। অধ্যাপক ও বিজ্ঞানী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবার পরও থেমে থাকেননি  তিনি।

 সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করার লক্ষ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লোকসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়ার জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কাজ করে গেছেন তিনি। দরিদ্র অশিক্ষিত মা-বাবার সন্তান হয়েও মেধা, পরিশ্রম ও নিষ্ঠার জোরে একজন মানুষ যে কত বড় হয়ে উঠতে পারেন মেঘনাদ সাহা তার জ্বলন্ত প্রমাণ।

১৮৯৩ সালের ৬ অক্টোবর, সে-বছরও পাঁজিতে ছিল অক্টোবরের আকাশ জুড়ে মেঘ, ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস। এই ৬ অক্টোবর ঢাকার বংশাই নদীর ধারে শ্যাওড়াতলি গ্রামে জগন্নাথ সাহার স্ত্রীর প্রসববেদনা শুরু হল। জগন্নাথ সাহা মুদির দোকানি ও হাঁটুরে ব্যবসায়ী, অবস্থা তেমন সচ্ছল নয়। তবুও কিন্তু এই প্রথম তাঁর সন্তান হচ্ছে না, এর আগে স্ত্রী ভুবনেশ্বরী দুই ছেলে, দুই মেয়ের জন্ম দিয়েছেন। এদিন প্রসববেদনা উঠতেই গ্রামের ধাই এসে হাজির, সেকালে বসতঘরের বাইরে আলাদা করে সন্তান জন্ম দেওয়ার জন্য আঁতুড়ঘর তৈরি করা হতো, তো, সেই ঘরে ভুবনেশ্বরীকে আনা হল। আর তখনই আকাশ উথালপাথাল করে বজ্রবিদ্যুৎ গায়ে মেখে শুরু হল ঝড়। ঝড়ের দাপটে উড়ে গেল আঁতুড়ঘরের খড়ের চাল। সেই বজ্রনির্ঘোষ ঘনঘটার মধ্যেই জন্ম হল ভারতের প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহার। ঝড়-বাদলা-মেঘ নিয়ে জন্ম হয়েছিল বলে ঠাকুমা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘মেঘনাথ’। কিন্তু পরে স্কুলের খাতায় তাঁর এই নাম ঠিক করে রাখা হয় ‘মেঘনাদ’। পরবর্তীকালে মাইকেলের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ তাঁর প্রিয় হয়ে উঠেছিল, আর সব চেয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছিল নায়ক ‘মেঘনাদ’। এই প্রিয় হয়ে ওঠাটা শুধু নামের মিলের জন্য নয়, নায়ক মেঘনাদের জেদ, অনমনীয়তা ও বীরত্বের জন্য।

বাবার কোন ইচ্ছেই ছিল না, বলা ভালো জীবনে যে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা প্রয়োজন আছে এমন কোন ভাবনাই ছিল না জগন্নাথের। মুদির ছেলে মুদি হবে, তিনি বুড়ো হলে ছেলেরা তাঁর মতো ব্যবসা সামলাবে, এটাই তো ভবিতব্য, এর আর ভাবাভাবির কী আছে! কাজেই বড়ছেলে জয়নাথের মেট্রিকের গণ্ডি আর পেরনো হল না। ঢাকায় ছুটতে হল ব্যবসায়ীর গদিতে ব্যবসার কাজ শিখতে আর খিদমত খাটতে। মেঘনাদের কপালে এই ভবিতব্যই নাচছিল। পরিবেশে, পরিবারে কোথাও পড়াশোনার আবহাওয়া ছিল না, উৎসাহ দেওয়ারও কেউ ছিল না, তবু পড়ুয়ার স্বভাব নিয়ে কেমন করে যেন জন্ম নিয়েছিলেন মেঘনাদ। পড়তে না পেলে তিনি কান্নাকাটি শুরু করে দিতেন। পড়ার জন্য খুব ভোরে উঠতেন। এসময় ভোররাত্তিরে জোরে জোরে পড়তে গিয়ে বাবার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় মারও খেয়েছেন অনেকবার। তবুও, পড়াশোনা থেকে কেউ তাঁর মুখ ফেরাতে পারেনি। এই রকম একটি পরিবেশ থেকেই শুধুমাত্র নিজের ইচ্ছেশক্তির প্রবলতায় উঠে এসেছিলেন, বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়েছিলেন মেঘনাদ সাহা।

বাবা জগন্নাথ সাহা ও মা ভুবনেশ্বরী দেবীর পঞ্চম সন্তান ছিলেন মেঘনাদ। জগন্নাথ সাহা ছিলেন একজন মুদি। ছোটবেলা থেকেই তাই রীতিমতো আর্থিক অনটেনর মধ্যে তাকে মানুষ হতে হয়েছিল। গ্রামের টোলে মেঘনাদের পড়ালেখার সূচনা হয়। গ্রামটিতে তৃতীয় শ্রেণির উপরে পড়ালেখার কোনও সুযোগ ছিল না৷ কিন্তু মেঘনাদের ইতিহাস আর গণিতের সাফল্যে তার শিক্ষকেরা তাকে একটি ইংরেজি স্কুলে পাঠানোর সুপারিশ করেন এবং গ্রামের মানুষের সহায়তায় তা সফল হয়।

ছোটবেলায় গ্রামের সরস্বতী পুজোয় তিনি দেবীর কাছাকাছি চলে গিয়ে ছুঁয়ে ফেলার অপরাধে এক নির্বোধ গোঁড়া পুরুতের কাছে চরম অপমানিত হয়েছিলেন।

 নিম্নজাতের ধুয়ো তুলে তাঁকে সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল। সেই থেকে সমস্ত দেবদেবীর পুজোর ওপর তিনি শ্রদ্ধা হারিয়েছিলেন, এমনকি বিদ্যার দেবীর ওপরেও, কিন্তু বিদ্যার ওপরে নয়।

কিন্তু এক বার সরস্বতী পুজোর দিন বদলে গিয়েছিল সব কিছু। পুজোমণ্ডপে অঞ্জলি দেওয়ায় মেঘনাদের উপস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল ব্রাহ্মণ ছাত্ররা। ব্যাপারটা এ রকম যে, তুমি যতই মেধাবৃত্তি পাও, আসলে তো ছোট জাত। তাই ব্রাহ্মণদের সঙ্গে এক আসনে বসার যোগ্যতা অর্জন করতে পারো না। মেঘনাদের ব্রাহ্মণ সহপাঠীদের ভাবগতিক এমনই ছিল। এই ঘটনাই জাতিভেদের বিরূদ্ধে আজীবন লড়াই করার বারুদ ভরে দিয়েছিল মেঘনাদের বুকে, যার ছাপ পড়েছিল তাঁর বিজ্ঞান গবেষণা থেকে শুরু করে রাজনৈতিক মতাদর্শে। 

সেই সঙ্গে গড়ে উঠেছিল বৈদিক ধর্মের প্রথা, প্রতিষ্ঠান এবং সেগুলিকে ব্যবহার করে হাজার হাজার বছর ধরে চলতে থাকা সামাজিক বিভেদের প্রতি বিদ্বেষ। সেই বিদ্বেষ এমনই জায়গায় পৌঁছেছিল যে তিনি পিতৃদত্ত নাম পর্যন্ত বদলে নিয়েছিলেন।

 ১৯৯০ সালের ১৪ জানুয়ারি, স্মিথসোনিয়ান ন্যাশনাল এয়ার অ্যান্ড স্পেস মিউজিয়ামের কিউরেটর ডেভিড ডিভরকিনকে লেখা এক চিঠিতে মেঘনাদ সাহার বড় ছেলে অজিত সাহা জানিয়েছিলেন, যে দিন তাঁর বাবা জন্মেছিলেন, সারা দিন ধরেই প্রচণ্ড ঝড়-জলের তাণ্ডব। আকাশ ভেঙে পড়ার অবস্থা। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী ঝড়-জলের দেবতা দেবরাজ মেঘরাজ ইন্দ্র। তাই দেবরাজ ইন্দ্রের নামানুসারে নবাগত শিশুর নাম রাখা হয়েছিল মেঘনাথ। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হিন্দুদের বৈদিক ধর্মীয় আচরণের গোঁড়ামি মেঘনাথকে এতটাই বিরক্ত করে তুলেছিল যে, তিনি নিজের নাম পাল্টে রেখেছিলেন মেঘনাদ। যিনি ইন্দ্রজিৎ। দেবতা নন, রাক্ষসদের প্রতিনিধি। সেই থেকে গোটা বিশ্বের কাছে তিনি মেঘনাথ নন, মেঘনাদ নামে পরিচিত হন। তাঁর চোখে মেঘনাদ ইন্দ্রজিৎ সমাজের অপমানিত অংশের প্রতিনিধি, যাঁকে অন্যায় ভাবে বধ করেছিল ব্রাহ্মণ সমর্থিত এক ক্ষত্রিয় রাজপুত্র। শুধু বিজ্ঞান বা রাজনৈতিক মতাদর্শ নয়, নিজের নাম বদলেও মেঘনাদ প্রমাণ করেছিলেন তিনি আসলে ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের পিছিয়ে পড়া বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।

তিনি নাস্তিক হলেও, সেই নাস্তিকতা শুধুই অপমান থেকে আসেনি, এসেছিল জ্ঞান থেকে। তিনি সমস্ত ধর্মের বই আত্মস্থ করে তারপর বিজ্ঞানের স্বচ্ছ দৃষ্টি নিয়ে জ্যোতির্বিজ্ঞানী হয়েছেন, ধর্মের পরস্পরবিরোধী দর্শন নিয়ে নয়।

 তাই আমাদের দীর্ঘদিনের পঞ্জিকার অনুমানমূলক জ্যোতিষগণনার পরিবর্তে তাতে জ্যোতির্বিদ্যার প্রবেশ ঘটিয়ে পঞ্জিকা সংস্কার করেন। বিশ্ববিজ্ঞানের সব কিছুই বেদে আছে, এই কথা যে বেদবাদীরা বলেন, তাঁদের বিরোধীতা করায় চরম প্রতিবাদের মুখে পড়েন মেঘনাদ, কিন্তু তিনি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, বিজ্ঞান আর দর্শন কখনই এক নয়, হতে পারে না। মাইকেলের কাব্যের নায়ক মেঘনাদের মতই কোনদিনই কোন চাপের কাছে, কোন বিরুদ্ধতার কাছে মাথা নত করেননি তিনি।

এরপর তিনি প্রাথমিক পরীক্ষায় তৎকালীন ঢাকা জেলার মধ্যে প্রথম স্থান অধিকার করায়। সে সময় মাসিক ৪ টাকার সরকারি বৃত্তি পান, বৃত্তির টাকা ও জয়নাথের পাঠানো পাঁচ টাকা নিয়ে তিনি ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তির উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন এবং ভর্তি হন। এরপর বৈশ্য সমিতির মাসিক দুই টাকা বৃত্তিও তিনি লাভ করেন।

এদিকে সেই সময় বঙ্গভঙ্গ বিরোধী আন্দোলন চলছিল। ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে পূর্ব বাংলার গভর্নর স্যার বামফিল্ড ফুলার আসবেন শুনে বিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী তার সম্মুখে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী মিছিল করবে নির্ধারণ করে। সে মিছিলে মেঘনাদও যোগ দেন। ফলে পরদিন তাকে স্বদেশী আন্দোলন এ জড়িত থাকার জন্য ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে ছাড়তে বাধ্য করা হয়। পাশাপাশি তার সরকারী বৃত্তিও বাতিল করা হয়।


পার্শ্ববর্তী কিশোরীলাল জুবিলি হাই স্কুলের একজন শিক্ষক স্বঃপ্রণোদিত হয়ে মেঘনাদকে তাদের স্কুলে ভর্তি বিনাবেতনে অধ্যয়নের ব্যবস্থা করেন। পরবর্তীতে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সী কলেজে অধ্যয়ন করেন।

সহপাঠি হিসেবে সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও উপরের শ্রেণির প্রশান্ত চন্দ্র মহালনবিশ, আচার্য হিসেবে জগদীশ চন্দ্র বসু ও আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের সান্নিধ্য লাভ করেন।

১৯১৩ সালে গণিতে সম্মানসহ বিএসসি করেন এবং ১৯১৫ সালে ফলিত গণিতে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন। উভয় পরীক্ষায় তিনি দ্বিতীয় এবং সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রথম হন।

মেঘনাদ তার সমস্ত গবেষণা ফলাফল গুলো একত্র করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে 'ডক্টর অব সায়েন্স' ডিগ্রির জন্য আবেদন করেন। তার সব গবেষণা বিবেচনা করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাকে ১৯১৯ সালে 'ডক্টর অব সায়েন্স' ডিগ্রি প্রদান করে। একইবছর মেঘনাদ প্রেমচাঁদ রায়চাঁদ বৃত্তি লাভ করেন। যার ফলে তিনি ইংল্যান্ড ও জার্মানীতে গবেষণার সুযোগ পান।

১৯১৬ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায় বিজ্ঞান কলেজ চালু করার পর সত্যেন্দ্রনাথ ও মেঘনাদ উভয়েই গণিত বিভাগের যোগ দিতে বলেন দেন। যদিও পরবর্তী কালে দুজনেই পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে চলে যান। সেখানে চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন পালিত অধ্যাপক হিসেবে পরবর্তীতে যোগ দেন। এরপর ১৯১৯ সালে তিনি প্রথম পাঁচ মাস লণ্ডনে বিজ্ঞানী আলফ্রেড ফাউলারের পরীক্ষাগারে এবং পরবর্তীতে বার্লিনে ওয়াস্টার নার্নস্টের সাথে কাজ করেন। দুইবছর ধরে দেশের বাইরে গবেষণা করার পর মেঘমাদ সাহা ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে খয়রা অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। কিন্তু কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার জন্য কোনো বরাদ্দ সেসময় না থাকায় তিনি ১৯২৩ সালে এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। তিনি ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। 

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি গণিতবিদ অমিয় চরন ব্যানার্জি এর সান্নিধ্য লাভ করেন। ১৫ বছর ধরে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি বিভাগটিকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করেন। এরপর তিনি মারা যাবার আগে অব্দি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এর বিজ্ঞান বিভাগের ডিন হিসেবে দ্বায়িত্বপালন করেছেন।

১৯১৭ সাল। ব্রিটিশশাসিত ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড চেম্সফোর্ড কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন স্থাপন করলেন। কমিশনের প্রধান হিসেবে বসানো হল এম ই স্যাডলারকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন কেমন চলছে তার রিপোর্ট তৈরি করাই স্যাডলারের দায়িত্ব। যদিও কমিশনের আসল উদ্দেশ্য অন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরমহলে নজর রাখা। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গের পর থেকেই কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্রিটিশ সরকারের চোখে বিপ্লবী তৈরির আখড়া। স্যাডলার একটা প্রশ্নপত্র তৈরি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী মিলিয়ে মোট ৬৭১ জনকে বিলি করেন। প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের সঙ্গে আরও দাবিদাওয়া আলাদা করে লিখে জানানো যাবে। স্যাডলার জানতেন, উত্তরপত্রে কড়া নজর থাকবে ব্রিটিশ গোয়েন্দাদের।

উত্তরদাতাদের মধ্যে একজনের উত্তরপত্র ছিল বেশ দীর্ঘ। পঠনপাঠনের সমস্যা ছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈষম্যময় পরিবেশের দিকেও আঙুল তুলেছিলেন। উত্তরপত্রে লেখা ছিল, “যদি বিশ্ববিদ্যালয়কে আবাসিক করে তোলার কথা ভাবা হয় এবং যথাযথ হস্টেলের ব্যবস্থা করা হয় তা হলে ‘ডেমোক্র্যাটিক ক্লাস’ বা গণতান্ত্রিক শ্রেণির (আমি তাদেরই গণতান্ত্রিক শ্রেণি বলে অভিহিত করছি, যাদের পিছিয়ে পড়া শ্রেণি বলা হয়) কথা ভাবতেই হবে। বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যে লাগোয়া হস্টেল রয়েছে, তাতে তথাকথিত উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণদের মৌরসিপাট্টা চলছে। সেই সঙ্গে যোগ দিয়েছে কায়স্থ ও বৈদ্য ছাত্রেরা। কোনও গণতান্ত্রিক শ্রেণির ছাত্রকেই ব্রাহ্মণ বা কায়স্থ ছাত্র এক ঘরে মেনে নেয় না বা একসঙ্গে খেতে বসলেও আপত্তি জানানো হয়।” উত্তরদাতা বছর কুড়ির এক লেকচারার মেঘনাদ সাহা। মাত্র দু’বছর আগে স্নাতকোত্তর পাশ করেছেন এবং স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের আহ্বানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে এসেছেন।


কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টে মেঘনাদ সাহার মতোই পিছিয়ে পড়া বা ‘নিচু জাত’-এর ছাত্রদের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন ব্রজেন্দ্রনাথ শীল। কিন্তু তাঁর ও মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গির বুনিয়াদি পার্থক্য ছিল, যা বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। ব্রজেন্দ্রনাথ তাঁর রিপোর্টে পিছিয়ে পড়া ছাত্রদের জন্য আলাদা আর্থিক তহবিল গড়ার প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। 

শীলের রিপোর্টে যুগ্গি, বারিক, সুবর্ণবণিক, নমঃশূদ্র, সাহাদের ‘ডিপ্রেসড ক্লাস’ বা কোথাও ‘লোয়ার কাস্ট’ বলে বর্ণনা করা হয়েছে।

 সেখানে মেঘনাদের রিপোর্টে এরা প্রত্যেকেই এক ছাতার তলায়, গণতান্ত্রিক শ্রেণি। নিজের রিপোর্টে পৃথক তহবিল গড়ে তোলাকে একদমই প্রশ্রয় দেননি মেঘনাদ। তিনি সবার সমান অধিকারের প3ক্ষে। মেঘনাদের দৃষ্টিভঙ্গি দেশের বর্তমান ভর্তুকিপুষ্ট শিক্ষা ব্যবস্থা ও সমাজ ব্যবস্থার সরাসরি বিপক্ষে। তিনি সেই সময়েই বুঝেছিলেন, উচ্চবর্ণ-নিম্নবর্ণের বিভেদ টেনে এবং ভর্তুকি দিয়ে কোনও এক বিশেষ শ্রেণির উন্নতির সম্ভাবনাকে মেরে ফেলায় দেশের সত্যিকারের উন্নতি সম্ভব নয়। 

২৮ বছর পরে, দেশভাগের সময়েও মেঘনাদ সাহার গলায় ধ্বনিত হয়েছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন রিপোর্টেরই সুর। তখন তিনি আর ২০ বছরের লেকচারার নন। প্রথিতযশা বিজ্ঞানী। কিন্তু ল্যাবরেটরির বাইরে এসেও তিনি শুনিয়েছিলেন তাঁর সাম্যের গান। স্বাধীনতার বছর দুই আগে সায়েন্স অ্যান্ড কালচার পত্রিকায় মেঘনাদ লেখেন, “দেশভাগের ফলে ভারতে থাকা মুসলমানরা হিন্দুরাজের পদদলিত হয়ে থাকবে এবং সংখ্যালঘু শ্রেণিতে পরিণত হবে বলেই মনে হয়। খুব স্বাভাবিক ভাবেই দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকেও একটা কড়া জাতীয়তাবাদের রেখা দিয়ে ভাগ করে দেওয়া হবে, যা সংখ্যালঘু শ্রেণির মধ্যে ডেকে আনবে সীমাহীন দারিদ্র্য।” পরের বছর ফের একই পত্রিকায় লেখেন, 

“সত্যিকারের স্বাধীনতা পেতে হলে, অশিক্ষা থেকে মুক্তি পেতে হলে, রোগ-জরা-ব্যাধি থেকে মুক্তি পেতে হলে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে যেতে হবে।”

 ‘আওয়ার ন্যাশনাল ক্রাইসিস’ শিরোনামের সেই প্রবন্ধে মেঘনাদের মূল বক্তব্য ছিল, সবাইকে কর্মযজ্ঞে শামিল করতে হবে, তা না হলে প্রকৃত স্বাধীনতা আসবে না। 

মেঘনাদ এবং সত্যেন বোস যুগ্মভাবে সর্বপ্রথম আলবার্ট আইনস্টাইনের সাধারণ আপেক্ষিকতার তত্ত্ব সহ তার বিভিন্ন নিবন্ধ ইংরেজি ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। আইনস্টাইনের ১৯০৫ থেকে ১৯১৬ সাল পর্যন্ত মোট যতগুলি নিবন্ধ জার্মান ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল তার সবগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ শুরু করেন মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন্দ্রনাথ বসু। তাদের এই অনুবাদ ১৯১৯ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে 'প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটি' নামে প্রকাশিত হয়। অনূদিত বইটির ভূমিকা লেখেন প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ। ১৯৭৯ সালে আইনস্টাইনের জন্মশতবার্ষিকী অনুষ্ঠানে বলা হয় আইনস্টাইনের নিবন্ধগুলির প্রথম অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছিল জাপানে।

এই ভুল সংশোধন করে অনুষ্ঠানে উপস্থিত নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী সুব্রহ্মণ্যন চন্দ্রশেখরের চেষ্টায় আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদের স্বীকৃতি পান সাহা ও বসু। তাদের এই অনূদিত প্রিন্সিপাল্‌স অব রিলেটিভিটির একটি প্রতিলিপি প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনস্টাইন আর্কাইভে সংরক্ষিত আছে। সাহা ও বসুর এই অনুবাদ সর্বপ্রথম ইংরেজিতে অনুবাদ শুধু নয়, সারাবিশ্বে এটিই আইনস্টাইনের রচনার প্রথম অনুবাদ।

১৯৩০ সালে ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী দেবেন্দ্র মোহন বসু এবং শিশির কুমার মিত্র মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত করেন।

নোবেল কমিটি মেঘনাদ সাহার কাজকে পদার্থবিজ্ঞানের একটি উল্ল্যেখযোগ্য প্রয়োগ হিসেবে বিবেচনা করলেও এটি “আবিষ্কার” নয় বলে তিনি নোবেল পুরস্কার পাননি।

 মেঘনাদ সাহাকে ১৯৩৭ সালে এবং ১৯৪০ সালে আর্থার কম্পটন এবং ১৯৩৯, ১৯৫১ ও ১৯৫৫ সালে শিশির কুমার মিত্র আবারও মনোনীত করলেও নোবেল কমিটি তাদের সিদ্ধান্তে অনড় থাকে৷

তিনি ভারতে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সে আধুনিক গবেষণার জন্য ১৯৫০ সালে পশ্চিমবঙ্গে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স প্রতিষ্ঠা করেন। পদার্থবিজ্ঞানে তার অবদানের জন্য ১৯২৭ সালে লন্ডনের রয়াল সোসাইটি তাকে এফআরএস নির্বাচিত করে।


তিনি গণিত নিয়ে পড়াশোনা করলেও পদার্থবিজ্ঞান ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়েও গবেষণা করেছেন। তিনি তাত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে 'তাপীয় আয়নীকরণ তত্ত্ব' প্রতিষ্ঠাতা করেন। তার আবিস্কৃত 'সাহা আয়নীভবন সমীকরণ' নক্ষত্রের রাসায়নিক ও ভৌত ধর্মগুলো ব্যাখ্যা করতে অপরিহার্য।

তিনি ও তার সহপাঠী এবং সহকর্মী সত্যেন্দ্রনাথ বসু সর্বপ্রথম আইনস্টাইনের 'স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি' জার্মান থেকে ইংরাজি অনুবাদ করেন যা কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত হয়। এছাড়া ভারতের নদী নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন। তিনি ভারতে পদার্থবিদ্যার বিকাশ ও প্রসারের জন্য ১৯৩১ সালে 'ন্যাশনাল একাডেমী অব সায়েন্স, ইন্ডিয়া' প্রতিষ্ঠা করেন। এছাড়াও ১৯৩৪ সালে ভারতে পদার্থবিজ্ঞানীদের সংগঠন 'ইন্ডিয়ান ফিজিক্যাল সোসাইটি'ও প্রতিষ্ঠা করেন। তার উদ্যোগেই ভারতে 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব সায়েন্স' এর সূচনা হয়, যা বর্তমানে 'ইন্ডিয়ান ইন্সটিউট অব টেকনোলজি' (আই. আই. টি.) নামে বর্তমানে পরিচিত।

১৯৫২ সালে স্বতন্ত্র প্রার্থী রূপে ভারতীয় লোকসভার কলকাতা উত্তর-পশ্চিম লোকসভা কেন্দ্র (বর্তমানে কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্র) হতে নির্বাচিত সাংসদ হন।

কিন্তু কেমন ছিলেন ব্যক্তি মেঘনাদ? তাঁর ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা থেকে জানা যায়, স্পষ্টবক্তা হিসেবে ‘কুখ্যাতি’ ছিল মেঘনাদের। আসলে কাজের জায়গায় কোনও রকম কুঁড়েমি তিনি পছন্দ করতেন না। ছাত্ররা তাঁকে ভয় পেত। 

কিন্তু কড়া শিক্ষকের ভিতরে লুকিয়ে ছিল এক ছাত্রদরদি নরম মনের মানুষ। ব্রজেন্দ্রকিশোরের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়,

 দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় যখন কলকাতায় জাপানি বোমাতঙ্ক ছড়িয়েছে, অধ্যাপক সাহার সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে গিয়ে থাকতে শুরু করেছিলেন তিনি। সকালে চা খেয়ে পড়াশোনা, গবেষণার কাজ শুরু করায় অভ্যস্ত ছিলেন ব্রজেন্দ্রকিশোর। কিন্তু অধ্যাপক সাহার বাড়ির রান্নার লোক অনেকটাই দেরি করে আসতেন। ছাত্রের অসুবিধের কথা ভেবে নিজে হাতে চা তৈরি করে খাওয়াতেন তিনি। তবে হঠাৎ করে রেগে যাওয়াও ছিল মেঘনাদের স্বভাবের একটি অঙ্গ। আসলে, অসম্ভব প্রতিভার অধিকারী মানুষটি সারা জীবনই বঞ্চনা ও গঞ্জনার শিকার - যা প্রভাব ফেলেছিল তাঁর স্বভাবেও। এমনকি নিজের বিবাহেও সহ্য করতে হয়েছিল গঞ্জনা। 

মেঘনাদ সাহার বউমা বিশ্ববাণী সাহার লেখা থেকে জানা যায়, ১৯১৮ সালে রাধারাণী রায়ের সঙ্গে বিবাহ হয় মেঘনাদের। বিয়েতে তাঁর পাঞ্জাবির তলা দিয়ে ছেঁড়া গেঞ্জি দেখা যাচ্ছিল। পাত্রের দুর্দশা দেখে বিয়েতে প্রচণ্ড আপত্তি জানিয়েছিলেন রাধারাণীর ঠাকুমা। আসলে গবেষণায় মগ্ন মানুষটি তখনও জীবনে বিশেষ টাকাকড়ি করে উঠতে পারেননি। কিন্তু তা বলে বিদ্যাচর্চায় খামতি থাকেনি। গবেষণাগার থেকে ফিরেও বইয়ের জগতে ডুবে যেতেই পছন্দ করতেন। বাড়িতে ছিল নিজস্ব লাইব্রেরি। রবীন্দ্রনাথ ও শেক্সপিয়রের ভক্ত ছিলেন। 

মেঘনাদ সাহার তৃতীয় কন্যা চিত্রা রায় জানিয়েছেন, অধ্যাপক সাহা যখন গবেষণার কাজ সেরে বাড়িতে ফিরতেন, শেক্সপিয়রের ‘কমেডি অব এররস’ থেকে পড়ে শোনাতে হত তাঁকে। অধ্যাপক সাহার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে জায়গা পেয়েছিল বিশ্বসাহিত্যের বিশাল সম্ভার - যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ম্যাক্সিম গোর্কি, নুট হামসুন, লিয়ো টলস্টয়ের লেখা বইপত্র। অধ্যাপক সাহার এই সাহিত্যপ্রেম দানা বেঁধেছিল ইলাহাবাদে থাকাকালীন। ইলাহাবাদে সেই সময়ে একটা বাংলা সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল, যার মধ্যমণি ছিলেন প্রবাসী পত্রিকার সম্পাদক রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। এ ছাড়াও ছিলেন যোগেনচন্দ্র গুপ্ত। এঁদের সান্নিধ্য অধ্যাপক সাহার কাছে ছিল বিজ্ঞান ও রাজনীতির বাইরে এক ঝলক মুক্ত বাতাসের মতো। সাহিত্য পাঠ ও চর্চা ছাড়াও দেশবিদেশের পত্রিকা সংগ্রহে তাঁর উৎসাহ ছিল। বাড়ির ছোটদের ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিক ম্যাগাজ়িন থেকে বিভিন্ন ছবি দেখাতেন, অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি পড়ে শোনাতেন। ছোটদের জন্য কলমও ধরেছিলেন কয়েক বার, যা প্রকাশিত হয় যোগেনচন্দ্র গুপ্তের ‘শিশুভারতী’ পত্রিকায়। সাহিত্য ছাড়াও অধ্যাপক সাহা উৎসাহী ছিলেন ভাষাতত্ত্ব চর্চায়। বিদেশি ভাষা শেখার প্রতি তাঁর আকর্ষণের সূত্রপাত ঢাকার স্কুল থেকে। ছাত্রাবস্থায় ঢাকা ব্যাপটিস্ট মিশন আয়োজিত এক পরীক্ষায় তিনি সংস্কৃত, বাংলা ও ইংরেজিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়েছিলেন। ইন্টারমিডিয়েটে জার্মান ভাষার সঙ্গে পরিচয়। এর পরে সারা জীবনই যখন সুযোগ পেয়েছেন বিভিন্ন ভাষা চর্চা করে গিয়েছেন। রমাপ্রসাদ চন্দ্র, সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়, বিরজা শঙ্কর গুহর সঙ্গে বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাষা চর্চা করতেন নিয়মিত। সেই বিষয়ে একাধিক বই সংগ্রহ করাটাও তাঁর নেশা ছিল। 

‘দেশ’ পত্রিকাকে (১৯৯৩, ৯ অক্টোবর সংখ্যা) দেওয়া সাক্ষাৎকারে জ্যোতির্বিজ্ঞানের পণ্ডিত ডেভিড ডিভরকিন জানিয়েছিলেন, মেঘনাদ সাহাকে পদার্থবিদ্যায় নোবেল প্রাইজ়ের জন্য মনোনীত করার চেষ্টা করেছিলেন ১৯২৭-এর পদার্থবিদ্যায় নোবেলজয়ী আর্থার কম্পটন। কিন্তু বিজ্ঞান গবেষণায় ভাটা পড়ার কারণেই হোক বা দেশীয় বিজ্ঞানীদের বিরোধিতায়, নোবেল প্রাইজ় তিনি পাননি। তাঁর জীবনযাপনের দিকে চোখ রাখলে বোঝা যায়, নোবেল পুরস্কারের মুখাপেক্ষীও ছিলেন না তিনি। তাঁর ধ্যান-জ্ঞান ছিল বিজ্ঞানের হাত ধরে জাতিভেদ, অসাম্যকে জয় করা এবং তথাকথিত উঁচু তলার মানুষদের তৈরি করা বিভাজন রেখাকে মুছে ফেলা। আমৃত্যু সেই কাজটাই করে গিয়েছেন মেঘনাদ নিষ্ঠার সঙ্গে।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিজ্ঞান সংগঠক মেঘনাদকে না পেলে ভারত বিজ্ঞান গবেষণায় সাবালক হয়ে উঠত না।

কংগ্রেসের চরকা কাটার নীতির বিরোধিতার কারণে দেশের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ভাল ছিল না, যা বাধা সৃষ্টি করেছিল মেঘনাদ সাহার কর্মকাণ্ডে। স্বাধীনতার পরে, ভারত সরকারের পারমাণবিক শক্তি কমিশনেও তাঁর মতামত অগ্রাহ্য করা হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান সংগঠক হিসেবে নিজের কাজ করে গিয়েছেন তিনি। এশিয়া মহাদেশের প্রথম সাইক্লোট্রন যন্ত্র তৈরির পরিকল্পনা করা, প্রথম ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ তৈরিও তাঁর সাহসী পদক্ষেপের পরিচয় বহন করে। এ ছাড়াও দেশীয় উপাদানে নিজের বিটা স্পেকট্রোমিটারও তৈরি করেছিলেন অধ্যাপক সাহা, যার সাহায্যে ভারতীয় খনিজ পদার্থের তেজস্ক্রিয়তা জরিপ করা, এ দেশে জীববিজ্ঞানের গবেষণাকেন্দ্রিক বিজ্ঞান বা নিউক্লিয়ার সায়েন্সের প্রয়োগ তাঁর হাত ধরেই শুরু হয়। 

১৯৫৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আচমকাই মৃত্যু এসে থামিয়ে দিয়েছিল এই বিশাল কর্মযজ্ঞ। ছাত্র ব্রজেন্দ্রকিশোরের লেখায় আছে, ‘ড. জ্ঞান ঘোষের ফোনে অধ্যাপক সাহার অসুস্থতার খবর পাই। ওয়েলিংটন নার্সিংহোমে পৌঁছে জানতে পারি সব শেষ।’ 


বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। কিন্তু তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল, তিনি সময়ের আগে জন্মেছিলেন। তাঁর কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত হয়ে উঠতেই পারেনি তৎকালীন ভারত। তাই বিজ্ঞান বা রাজনীতি, সব ক্ষেত্রেই তিনি প্রতিষ্ঠানবিরোধী। একটা বিষয় লক্ষ করার মতো, ভারতীয় বিজ্ঞানের তিন নক্ষত্র প্রফুল্লচন্দ্র রায়, জগদীশচন্দ্র বসু, সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে আচার্য হিসেবে অভিহিত করা হয়। কিন্তু মেঘনাদ সাহা আজও শুধুই অধ্যাপক সাহা। এ ক্ষেত্রেও তিনি ডেমোক্র্যাটিক ক্লাসের প্রতিনিধি, যাদের ‘পিছিয়ে পড়া’ বলা হয়, জোর করে পিছিয়ে রাখা হয়।

বিপ্লবী পদার্থ বিজ্ঞানী মেঘনাদ সাহা - প্রতিবাদের এক শক্তিশেলের নাম। বিজ্ঞানে ব্যক্তিগত সাফল্যের ঊর্ধ্বে মেঘনাদ সাহা স্থান দিয়েছিলেন দেশকে, জাতিকে, দেশের অর্থনীতিকে। ছয়বার নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পেয়েছিলেন। সারাজীবন লড়াই করেছেন জাতপাত, দারিদ্রের বিরুদ্ধে। আজ মেঘনাদ সাহার জন্মদিবস। আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম।

তথ‍্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আনন্দবাজার পত্রিকা, চ‍্যানেল হিন্দুস্তান, কোলকাতা ২৪×৭ ডট কম, ব্লগ ডট মুক্তমনা ডট কম, উইকিপিডিয়া, ড. চিত্রা রায়, ‘ডিসপার্সড রেডিয়েন্স, কাস্ট, জেন্ডার অ্যান্ড মডার্ন সায়েন্স ইন ইন্ডিয়া’ : আভা শূর, ‘মেঘনাদ সাহা : দ্য সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড দ্য ইনস্টিটিউট বিল্ডার’: শান্তিময় চট্টোপাধ্যায়, ইন্ডিয়ান জার্নাল অব হিস্ট্রি অব সায়েন্স - ২৯ (১), ১৯৯৪, দেশ পত্রিকা - ১৯৯৩, ৯ অক্টোবর সংখ্যা।

বিস্মৃতির অন্তরালে: অক্ষয়কুমার দত্ত -
পার্থ সারথি চন্দ্র
Nov. 20, 2024 | জীবনী | views:890 | likes:2 | share: 1 | comments:0

গভীর রাত। এক তিনতলা বাড়ির ছাদে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া চলছে। তবে তা নিচু গলায়। স্বামী ভদ্রলোকটির কণ্ঠ উচ্চকিত নয়। যুবকটির ‘অপরাধ’, তিনি স্ত্রীর প্রতি মনোযোগী নন। এই গভীর রাতে বাড়ির ছাদে বসে তিনি এক 'খগোল' যন্ত্র নিয়ে আকাশের গ্রহ-নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করছেন। জ্যোর্তিবিজ্ঞান তাঁর প্রাণের বিষয়। আকাশ জুড়ে সারা রাত যে মহাজাগতিক বিস্ময়ের ঘটনা চলতে থাকে, সে সবের সাক্ষী থাকতে হলে যে রাত ছাড়া উপায় নেই! বিরক্ত, ক্ষুব্ধ স্ত্রী ছাদে উঠে এসেছেন আজ। এমন লোক কে দেখেছে, যে দুই প্রহর-আড়াই প্রহর রাতে স্ত্রীর শয্যা ছেড়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে! এ তো সামান্য বিড়ম্বনা নয়! উত্তরে যুবকটি শান্ত কণ্ঠে বললেন, “এমন লোকের স্ত্রী এরূপ কথা বলে, তা যে আরও বড় বিড়ম্বনার।”


খগোল-যন্ত্র হল 'দূরবিন'। পারিভাষিক শব্দ 'দূরবীক্ষণ'। এই নামটি দিয়েছেন রাত-জাগা ওই যুবক - অক্ষয়কুমার দত্ত। বিজ্ঞান, গণিত, ভূগোলের ক্ষেত্রে আরও অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন তিনি। যেমন, অণুবীক্ষণ, চুম্বক, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, জড়, তড়িৎ, পরিমিতি, ধ্রুবতারা, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, জোয়ার, রামধনু, সৌরজগৎ, মাধ্যাকর্ষণ, গ্রহণ, সুমেরু, কুমেরু, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি। এগুলি নমুনা মাত্র। তালিকাটি দীর্ঘ। বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান চর্চাকে পথ দেখিয়েছিল এই পরিভাষা।


আধুনিককালের প্রগতি ভাবনা সম্পর্কে আমাদের সবারই কমবেশি ধারণা রয়েছে। কাজেই বিস্তারিত আলােচনার প্রয়ােজন নেই। রাজা রামমােহন রায়ই ঊনিশ শতকের গােড়ায় গােটা ভারতে নতুন যুগের প্রবর্তক, প্রথম প্রগতিবাদী মানুষ। তার ব্যক্তিত্ত্ব ও বৈষয়িক জীবনে নানা অসংগতি থাকলেও বিদ্যায়-বিত্তে-জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় তিনি তাঁর সমকালের প্রথম সারির যে কোনাে প্রাগ্রসর চিন্তাসম্পন্ন ইউরোপীয় নাগরিকের সমকক্ষ ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে নবযুগের উদ্গাতা, দূরদর্শী ও বিজ্ঞানমনস্ক চিন্তাবিদ। প্রগতিশীল যুক্তিবাদের আরও প্রসার ঘটে লুই ভিভিয়ান ডিরোজিওর প্রভাবে ও প্রচারে হিন্দু কলেজের ছাত্রদের মধ্যে। শাস্ত্রিক সামাজিক লৌকিক বিধাসসংস্কার থেকে মুক্তি ছিল তাদের জীবনে নবলব্ধ যুক্তিবাদের অবদান। কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের প্রগতিশীলতা আমরা খুব একটা স্বীকার করি না বটে, কিন্তু তিনিই প্রথম বুঝেছিলেন যে, সাহিত্য বিনোদনের বস্তু নয়, জাতীয় জীবনবিকাশের ভিত্তি ও অবলম্বনও। এরপর ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যুক্তিনির্ভর জ্ঞানমনস্কতা, যা তাঁর প্রগতিশীলতার এবং পাশ্চাত্য প্রভাবিত প্রাগ্রসর চিন্তাভাবনারই উজ্জ্বল নিদর্শন। বিদ্যাসাগরেরই সমবয়সী অক্ষয়কুমার দত্ত ছিলেন আর একজন জিজ্ঞাসুদ্রোহী।


অক্ষয়কুমার দত্ত একাধারে গ্রন্থকার, প্রাবন্ধিক, বাংলা গদ্যের রূপকার, দার্শনিক, ফলিত বিজ্ঞান গবেষক, বিজ্ঞানমনস্ক, আধুনিক, ধৰ্মীয় ছুঁতমার্গহীন মানুষ। তিনি ছিলেন বিশুদ্ধ জ্ঞানের উপাসক,তত্ত্বানুসন্ধিৎসু বুদ্ধিমান মানুষ। সমকালীন বিশ্ব মানসিকতা তাঁর মধ্যে সংকলিত হয়েছিল। অগস্ত্যত কোঁৎ-এর প্রত্যক্ষবাদ ও মানবতার আদর্শ, বেন্থাম-মিলের হিতবাদ বা উপযোগাত্মকতা, এমনকি হারবার্ট স্পেন্সারের সংশয় বা অজ্ঞেয়তা পর্যন্ত তাঁর চিত্তে প্রতিফলিত হয়েছিল। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি ছিলেন কঠোর নীতি পরায়ণ, বিনয়ী এবং দরিদ্রের প্রতি দয়াশীল। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী যথার্থই বলেছেন, “তিনিই বাঙালির সর্বপ্রথম নীতি শিক্ষক।” মৌলিক বিজ্ঞান গবেষণার কেন্দ্র রূপে তাঁর অকৃত্রিম দানেই গড়ে উঠেছিল আজকের 'ইন্ডিয়ান আ্যসোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অফ সায়েন্স'। প্রকৃতপক্ষে বিশ্ব মনীষীদের সঙ্গে তাঁর ছিল আত্মিক সংযোগ। তাঁর শয়নশিখরে থাকত ডারউইন ও নিউটনের প্রতিকৃতি, ঘরের দেওয়ালে থাকত জ্যোতিষ্ক-লেখা গগনপট, নরকঙ্কাল, এবং পশুপঞ্জর (জাস্টিস সদাচরণ মিত্রের ভাদ্র ১৩১২ বঙ্গাব্দের বঙ্গদর্শনে প্রদত্ত বিবরণ)। 


বর্ধমান জেলায় নবদ্বীপের কাছে চুপী গ্রামে ১৮২০ সালের ১৫ জুলাই জন্মেছিলেন অক্ষয়কুমার। পিতা পীতাম্বর দত্ত এবং মাতা দয়াময়ী দেবীর কনিষ্ঠ পুত্র অক্ষয়কুমার। তাঁর পিতা কোলকাতায় পুলিশে চাকরি করতেন। গ্রামের স্কুলে কিছুদিন পড়ার পর তিনি কলকাতার ওরিয়েন্টাল সেমিনারিতে পড়তে আসেন। কয়েক বছর পড়াশোনা করার পর পিতার মৃত্যু হলে তাঁকে লেখাপড়া ছেড়ে দিতে হয়। তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা এত দূর পর্যন্তই। পিতার মৃত্যুর পর দারিদ্র্য-দশার ভিতর প্রতিপালিত হয়েছেন। এরপর তিনি অর্থোপার্জনে উদ্যোগী হন। কিন্তু পাশাপাশি অদম্য ছিল তাঁর জ্ঞানস্পৃহা। তাই বাড়িতেই নিজ উদ্যোগে পড়াশোনা চালিয়ে যান। স্কুলের ইংরেজ শিক্ষক বহুভাষাবিদ পণ্ডিত জেফ্রয়ের পৃষ্ঠপোষকতা পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর কাছে গ্রিক, ল্যাটিন, জার্মান, ফরাসি ও হিব্রু ভাষা ছাড়াও শেখেন পদার্থবিদ্যা, ভূগোল, জ্যামিতি, বীজগণিত, ত্রিকোণমিতি, সাধারণ বিজ্ঞান, মনস্তত্ত্ব প্রভৃতি। আর আমিরউদ্দীন মুন্সির কাছে শেখেন ফারসি ও আরবি ভাষা। পরবর্তীকালে ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক থাকার সময় কিছুদিন তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজে গিয়ে অতিরিক্ত ছাত্র হিসেবে উদ্ভিদবিদ্যা, প্রাণিবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র ও প্রকৃতিবিজ্ঞান পড়েছিলেন।


ব্রাহ্মধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘তত্ত্ববোধিনী সভা’ গঠন করলে তিনি তার সভ্য হন এবং ১৮৪০ খ্রিস্টাব্দে মাসিক আট টাকা বেতনে ব্রাহ্মদের প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ববোধিনী পাঠশালার ভূগোল ও পদার্থবিদ্যার শিক্ষক নিযুক্ত হন। এই বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষায় পাঠদানের সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু বাংলায় এসব বিষয়ে পাঠ্যপুস্তক না থাকায় তিনি ১৮৪১ সালে ‘ভূগোল’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তখন তাঁর বয়স মাত্র ২১। তখনও বিদ্যাসাগরের কোনো বই প্রকাশিত হয়নি। এই গ্রন্থটি অক্ষয় দত্তের প্রথম গদ্যগ্রন্থ হলেও তাঁর ভাষা পূর্ববর্তী বাংলা গদ্যের তুলনায় অনেক প্রাঞ্জল ও সরল। এই গ্রন্থে তিনিই প্রথম বাংলা ভাষায় যতি চিহ্ন ব্যবহার করেন। এই সেই ভাষার নমুনা: ‘পৃথিবীর আকৃতি প্রায় গোল যেমন কমলালেবু গোলাকার। অথচ তাহার বোঁটার নিকট কিঞ্চিৎ নিম্ন, সেইরূপ পৃথিবীও গোল কিন্তু উত্তর দক্ষিণে কিঞ্চিৎ চাপা।’ 


দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবেই তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। আগস্ট ১৬, ১৮৪৩ তারিখে তাঁর সম্পাদনায় ব্রাহ্মসমাজ ও তত্ত্ববোধিনী সভার মুখপাত্র ‘তত্ত্ববোধিনী’ পত্রিকা আত্মপ্রকাশ করে। রচনাসম্ভারে ও পরিচালনার গুণে পত্রিকাটি শ্রেষ্ঠ বাংলা সাময়িকপত্রে পরিণত হয়। যদিও পত্রিকার মূল উদ্দেশ্য ছিল ব্রাহ্মধর্ম প্রচার, কিন্তু অক্ষয় কুমার দত্ত ও তাঁর বন্ধু বিদ্যাসাগরের কারণে এটি সে সময়ে সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, পুরাতত্ত্ব, ভূগোল,  ইতিহাস ও সমাজ সংস্কার, বিষয়ে একটি অগ্রণী পত্রিকায় পরিণত হয়। স্ত্রী-শিক্ষার প্রসার ও হিন্দু-বিধবাদের বিবাহের সমর্থনে এবং বাল্যবিবাহ ও বিবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিবহুল বলিষ্ঠ লেখাও এতে প্রকাশিত হত। সচিত্র প্রবন্ধও থাকত। নীলকর সাহেব ও জমিদারদের প্রজাপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি এই পত্রিকায় নির্ভীকভাবে লেখনী চালনা করেন। দীর্ঘ বারো বছর তিনি এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন।


হিন্দু বিধবাবিবাহকে তিনি কতটুকু সমর্থন করতেন, ‘ছন্দের জাদুকর’ পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের লেখা তাঁর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে বর্ণিত একটি ঘটনা থেকে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। একবার অক্ষয় দত্তের এক কর্মচারী কয়েক হাজার টাকা নিয়ে পালিয়ে যান। তাঁকে চিঠি লিখে জেল-পুলিশের ভয় দেখালে তিনি জবাবে তাঁকে জানান, ‘আপনি আমাকে বলেছিলেন আমি বিধবাবিবাহ করলে আমাকে পুরস্কার দেবেন। আমি বিধবাবিবাহ করেছি।’ অক্ষয়কুমার খোঁজ নিয়ে জানলেন, সত্যিই তিনি একজন বিধবাকেই বিয়ে করেছেন। তিনি সেই কর্মচারীকে চিঠি লিখলেন, ‘তোমার সকল অপরাধ ক্ষমা করলাম’।’


‘ভূগোল’ প্রকাশের পনেরো বছর পর প্রকাশিত তাঁর ‘পদার্থবিদ্যা’ বাংলা ভাষায় লেখা প্রথম পূর্ণাঙ্গ বিজ্ঞানের বই। এ ছাড়া বিজ্ঞানের ও সাধারণ জ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখা ‘চারুপাঠ’ (প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ড) পাঠ্যপুস্তক হিসেবে জনপ্রিয় হয়েছিল। এসব গ্রন্থে তিনি বিজ্ঞান ও ভূগোলের অসংখ্য পারিভাষিক শব্দ তৈরি করেছিলেন। মাধ্যাকর্ষণ, আহ্নিক গতি, বিষুব রেখা, অক্ষাংশ, দ্রাঘিমা, চুম্বক, বিকিরণ, তড়িৎ, সুমেরু, কুমেরু, স্থিতিস্থাপকতা, আপেক্ষিক গতি, ভারকেন্দ্র, দূরবীক্ষণ, অণুবীক্ষণ, জ্যোতির্বিদ্যা, দাহ্য পদার্থ, পরিমিতি, জড়, জোয়ার, রামধনু, ধ্রুবতারা, গ্রহণ, অঙ্গার, বাষ্প, বজ্র, সৌরজগত, মানমন্দির, জ্বালামুখী, আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি অসংখ্য পরিভাষা আজ বাংলা ভাষার অঙ্গীভূত হয়েছে এবং আমরা প্রতিনিয়ত ব্যবহার করছি। বাংলা ভাষা নির্মাণে ও বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান শিক্ষা প্রবর্তনে অক্ষয় দত্তের যে অবদান, তার গুরুত্ব অপরিসীম। তাঁর কীর্তির অলক্ষ্য প্রভাব আমাদের ওপর এখনও বহমান। 


অক্ষয়কুমার দত্ত ১৮৪৩ খ্রিষ্টাব্দের ২১ ডিসেম্বর, দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অপর ২১ জন বন্ধুর সঙ্গে রামচন্দ্র বিদ্যাবাগীশের কাছে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষাগ্রহণ করেন। উল্লেখ্য এই দলই প্রথম দীক্ষিত ব্রাহ্ম। অক্ষয়কুমার তেইশ বছর বয়সে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু স্বাধীন চিন্তা ও নিবিড় বিজ্ঞানচর্চার কারণে এই সমাজবিজ্ঞানী সব ধরনের ভাববাদিতা ও সংস্কার থেকে মুক্ত ছিলেন। যাত্রার ‘শুভ-অশুভ’ ক্ষণ বলে কিছু যে নেই তা প্রমাণ করার জন্য শাস্ত্রে ‘অশুভ’ এমন দিনক্ষণ দেখে তিনি ভ্রমণে বেরোতেন। অক্ষয় দত্তও হিন্দু ও ব্রাহ্মদের নিকট ঐশ্বরিক গ্রন্থ হিসেবে বিবেচিত বেদকে মানুষের রচনা এবং সে কারণে অভ্রান্ত নয় বলে ঘোষণা করেন। ব্রাহ্মসমাজে সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে বাংলা ভাষায় ঈশ্বরোপাসনার তিনি অন্যতম প্রবর্তক। পরে তিনি প্রার্থনাদির প্রয়োজন স্বীকার করতেন না এবং শেষ বয়সে অনেকটা অজ্ঞাবাদী হয়ে পড়েন। ধর্ম–সম্পর্কিত এই দৃষ্টিভঙ্গির জন্য ব্রাহ্মসমাজের পত্রিকা ‘তত্ত্ববোধিনী’তে কাজ করা অক্ষয় দত্তের জন্য অসুবিধাজনক হয়ে ওঠে। অন্যদিকে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের জন্য, প্রচলিত পথের বাইরে হাঁটার জন্য তৎকালীন সমাজপতিরা  তাঁকে একঘরে করার চেষ্টা করেন ও কিছুক্ষেত্রে সফলও হন। 


হিন্দু হোস্টেলের এক দল ছাত্র অক্ষরকুমারকে ঈশ্বর-প্রার্থনার উপযোগিতা নিয়ে প্রশ্ন করল। তিনি বীজগণিতের সমীকরণ দিয়ে দেখালেন: পরিশ্রম=শস্য। পরিশ্রম+প্রার্থনা=শস্য। অতএব, প্রার্থনা=শূন্য। ছাত্ররা এই উপস্থাপনার নাটকীয়তায় স্তম্ভিত হয়ে গেল। তাদের মুখে মুখে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এই সমীকরণ। শিক্ষিত মহলেও আলোড়ন উঠল। এই ঘটনার দু’দিন পর মেডিকেল কলেজের ‘ডিমনস্ট্রেটর’ বাবু নীলমাধব মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে অক্ষয়কুমারের দেখা, নীলমাধববাবু হাসতে হাসতে বলিলেন, ‘‘আপনি ভাল এক সমীকরণ দিয়া শহরটা তোলপাড় করিয়া দিয়াছেন।”


অক্ষয়কুমারের একটি বইয়ের জন্য স্কুলে আগুন লাগাতে চেয়েছিল কিছু লোক। ঢাকার বিক্রমপুরের ঘটনা। ১৮৫১ সাল। সদ্য বেরিয়েছে ‘বাহ্যবস্তুর সহিত মানবপ্রকৃতির সম্বন্ধবিচার’ বইটি। বিক্রমপুরের কালীপাড়া স্কুলের এক দল ছাত্র বই পড়ে মুগ্ধ। দেড়শো বছরেরও আগে সেই বইয়ে অক্ষয়কুমার লিখছেন: "বিবাহের আগে হবু দম্পতি পরস্পরের সঙ্গে ভাল ভাবে আলাপ-পরিচয় করে নেবে। স্বামী ও স্ত্রীর মধ্যে বয়সের পার্থক্য যেন বেশি না থাকে। সংসারে নারী ও পুরুষের কর্তব্য ও দায়িত্ব সমান। যদি স্বামী ও স্ত্রীর সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে এবং সমাধানের কোনও পথ খুঁজে না পাওয়া যায়, সে ক্ষেত্রে বিবাহবিচ্ছেদ কাম্য।"


তোলপাড় পড়ে গেল সর্বত্র। কালীপাড়া স্কুলের কিছু ছাত্র সভা করে প্রতিজ্ঞাপত্রে স্বাক্ষর করলেন: ‘আমরা এই পুস্তকে লিখিত বিবাহাদির নিয়মসকল অবলম্বন করিব।’ ধর্মান্ধ রক্ষণশীল মহলে তীব্র ক্ষোভ দেখা দিল। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন, স্কুলবাড়িটাই পুড়িয়ে দেবেন। তবে এই হুমকিতে অগ্রণী ছাত্রদের প্রতিহত করা যায়নি। অনেকেই গৃহত্যাগী হয়েছিলেন সে দিন। অক্ষয়-জীবনীকার মহেন্দ্রনাথ রায় লিখেছেন: “উপস্থিত বৃত্তান্তটি সঞ্জীবনী-পত্রিকার সম্পাদক শ্রীযুক্ত বাবু দ্বারকানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের নিকট হইতে প্রাপ্ত হওয়া যায়। তিনি ঐ সময়ে ঐ স্কুলের ছাত্র ছিলেন।” দ্বারকানাথের উপরেও এর প্রভাব পড়েছিল। তাঁরা কুলীন ছিলেন, পরিবারে প্রায় সবাই বংশানুক্রমে চল্লিশ-পঞ্চাশটি করে বিবাহ করতেন। দ্বারকানাথ পরিবারের বিরুদ্ধে গিয়ে জানিয়েছিলেন, “আমি এক বই দুই বিবাহ করিব না।”


অক্ষয় দত্তের শিক্ষাচিন্তার আধুনিকতা এবং আজকের প্রাসঙ্গিকতা দেখে স্তম্ভিত হতে হয়। এখন আমরা আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে মুখস্থনির্ভরতা থেকে মুক্ত করা নিয়ে চিন্তিত। দেড়শ বছর আগে অক্ষয় দত্ত কী বলেছিলেন, ‘কালেজ ও স্কুলে যেরূপ শিক্ষাপ্রণালী ব্যবহৃত হইতেছে তাহা কেবল স্মরণশক্তি উন্নতিসাধনপক্ষে বিশেষ অনুকূল, বুদ্ধিবৃত্তির পরিচালনা ও উন্নতিসাধনের পক্ষে তত অনুকূল নহে। শুনিতে পাওয়া যায় যে, প্রধান প্রধান কালেজের অধ্যাপকেরা ছাত্রদিগকে কোনো প্রশ্ন করেন না। কেবল গ্রন্থের ব্যাখ্যা করিয়া যান, ছাত্রেরা কেবল নোট লয়। ইহাতে বুদ্ধিবৃত্তির কীরূপ পরিচালনা হইতে পারে, পাঠকবর্গ তাহা সহজে বুঝিতে পারেন।’


তিনি চেয়েছিলেন বিজ্ঞানচর্চা সুগম হবে মাতৃভাষায়। সাবলীল হবে অভ্যাস। উনিশ শতকে অক্ষয়কুমার দত্তের হাত ধরেই বাংলাভাষায় বিজ্ঞানচর্চার সূত্রপাত। এমনকি বাংলাভাষাকে তিনি  বিজ্ঞানচর্চার উপযোগী, দর্শনচর্চার এতটা  উপযোগী করেছিলেন যে অনেক সময় মনে হয় বিদ্যাসাগরের চেয়েও তিনি কয়েক কদম এগিয়ে ছিলেন। পাশ্চাত্যী বেকনীয় দর্শনের অন্যতম গুণগ্রাহী অক্ষয়কুমার দত্ত মাতৃভাষায় শিক্ষাদানের বিষয়ে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। বাংলা ভাষার প্রসারে তিনি যে গুরুত্ব দিতেন, তা অতুলনীয়। তিনিই প্রথম  অফিস-আদালত ও উচ্চশিক্ষাসহ সব স্তরে বাংলা ভাষা প্রচলনের কথা বলেছিলেন। প্রখ্যাত শিক্ষাব্রতী ডেভিড হেয়ারের মৃত্যুর পর তিনি প্রথা ভেঙে বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। 


অক্ষয়কুমার দত্ত বিশেষ করে আমাদের যে ঐতিহ্য সেটা নতুনভাবে বিশ্লেষণ করতে শিখিয়েছিলেন। তিনি প্রমাণ করেছেন সবটাই আমাদের ধর্মের ঐতিহ্য নয়। আমাদের দেশে যুক্তিবাদের ঐতিহ্য ছিল, নিরীশ্বরবাদের ঐতিহ্য ছিল। যেটাকে আমরা হিন্দু ঐতিহ্য বলছি তারমধ্যেই একটা বড়ো অংশ অনিশ্বরবাদ নিয়ে তিনি আলোকপাত করেছেন। তিনি উদাহরণ দিয়েছেন সাংখ্য দর্শন, মীমাংসা দর্শন যেগুলি খোলাখুলি ঈশ্বরবিরোধী ছিল।


‘তত্ত্ববোধিনী’ সম্পাদনার অমানুষিক শ্রম থেকে অব্যাহতি নিয়ে বিদ্যাসাগরের অনুরোধে নর্মাল স্কুলের অধ্যক্ষ পদে যোগ দিলেন। একটা মাস-মাইনে তো প্রয়োজন। কিন্তু এই কাজটাও করতে পারলেন না। বছর না ঘুরতে ছেড়ে দিলেন অধ্যক্ষের চাকরি। অসুস্থতার খবর পেয়ে জার্মানি থেকে ম্যাক্সমুলার চিঠি লিখেছেন অক্ষয়কুমারকে। ১৮৮৩ সালের ৩১ অগস্ট লেখা চিঠিতে উদ্বেগ: ‘আপনার অসুস্থতার খবর শুনে খুব দুঃখিত। আশা করি আপনি অন্য কোনও গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে পারবেন।’


অসুস্থতা নিয়েই করেছেন ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটির কাজ। হিন্দু ধর্মের নানা শাখাপ্রশাখা, নানান সম্প্রদায়, বিচিত্র আচরণ। অন্যান্য ধর্মও খুব ব্যতিক্রম নয়। এমনই ১৮২টা সম্প্রদায়কে নিয়ে দুই খণ্ডে প্রকাশিত এই বইয়ে তিনি প্রকাশ্যে ভাববাদী চিন্তাকে আক্রমণ করেছেন। কোনও কোনও সম্প্রদায়ের ধর্মাচরণকে মানসিক রোগ বলতেও ছাড়েননি। সব থেকে বড় কথা, এই বইয়ের অনেকটাই তাঁর নিজস্ব ক্ষেত্রসমীক্ষার ফসল। রোগ-অসুখ তাঁর নিষ্ঠার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি। এক দিন গাড়িতে বেরিয়েছেন, সঙ্গে অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায়। পথে এক ধাঙড়কে দেখতে পেয়ে অক্ষয়কুমার গাড়ি থামাতে বললেন। মানুষটি তাঁর পূর্বপরিচিত। ইতিমধ্যে আরও কয়েক জন ধাঙড় সেখানে এসে উপস্থিত। গাড়ি থামিয়ে তাঁদের কাছ থেকে অক্ষয়কুমার শুনলেন ধাঙড় সমাজের রীতিনীতি, দেবদেবীর পূজার্চনার বৃত্তান্ত। এ কথা-সে কথায় অম্বিকাবাবুও দু-একটা প্রশ্ন করলেন। কিন্তু ধাঙড়রা তাঁকে উত্তর দেবে না। অক্ষয়বাবুকে এত খাতির কেন? এক ধাঙড়ের উত্তর: “উনি আমাদের দেশে গিয়াছিলেন, উনি আমাদের (জাতের) ভেদ মারিয়াছেন।”


ক্ষমাপ্রার্থনা করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন অক্ষয়কুমার। আলাদা আলাদা সময়ে তিনটি পত্রিকায় তা প্রকাশিত হয়: ১২৯০ বঙ্গাব্দের ১১ বৈশাখ ‘সোমপ্রকাশ’-এ, ১২৯১-এর ৮ বৈশাখ ‘সঞ্জীবনী’ পত্রিকায় এবং ১৮৮৫-র ১০ জুন ‘নিউজ় অব দ্য ডে’ সংবাদপত্রে। অনুরাগীরা তাঁকে নানান বিষয়ে চিঠি লিখতেন, তিনি অসুস্থতার জন্য উত্তর দিতে পারতেন না। মনে মনে গ্লানি বোধ করতেন। তাই এই ক্ষমাপ্রার্থনা। আর একটি ‘ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপন’ অবশ্য বেশ মজার। “আমার এক ভৃত্য গত শুক্রবার প্রাতঃকালে স্বর্ণালঙ্কারে ও নগদে প্রায় আড়াইশত টাকা হরণ করিয়া পলায়ন করিয়াছে। যে ব্যক্তি তাহাকে বমাল সহিত ধরিয়া দিতে পারিবে তাহাকে উচিতমত পারিতোষিক প্রদান করা যাইবেক।” ‘সম্বাদ প্রভাকর’-এ ১২৬০ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে গয়নার বিবরণে আছে: হেলে হার ১ ছড়া, কণ্ঠমালা ১ ছড়া, বাজু ২ খানা, বালা ৪ গাছা।


অক্ষয়কুমার দত্ত শারীরিক অসুস্থতার জন্য বেশি ঘোরাঘুরি করতে পারতেন না। ফলে তাঁর সামাজিকভাবে উপস্থিতি ক্রমশ কমে আসছিল। সেটা অবশ্য সাপে বর হয়েছিল। প্রচন্ড শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চাকরি করা থেকে বিরত হন। কলকাতা থেকে দূরে কোথাও চলে যেতে চাইছিলেন। ১৮৫০ এর দশকে তিনি বালিতে জায়গা দেখে বাড়ি করে থাকতে শুরু করলেন। তাঁর জীবনের শেষ তিরিশটি বছর (১৮৫৬-১৮৮৬) তিনি বালিতে কাটান। আজ দেওয়ান গাজী তালায় যেটি ‘হরমিলার ডক’ বলে পরিচিত, সেটি তাঁর শেষ জীবনের বসতবাড়ি। লাগোয়া জমিতে তৈরি করলেন ‘শোভনোদ্যান’- উদ্ভিদবিদ্যা চর্চার ক্ষেত্র। অক্ষয়কুমার রচিত তিন খণ্ড ‘চারুপাঠ’ ছাত্রমহলে ব্যাপক জনপ্রিয় ছিল। তাই বিদ্যাসাগর এই উদ্যানের নাম দিয়েছিলেন ‘চারুপাঠ চতুর্থ ভাগ’। বাড়ির ভিতরেও তৈরি করেছিলেন একটি ভূতাত্ত্বিক সংগ্রহশালা। সেখানে ছিল বিভিন্ন যুগের প্রস্তরখণ্ডের নমুনা, ফসিল, প্রবাল প্রভৃতি। শরীর সঙ্গ দিত না, তবু কলকাতা জাদুঘরে বা শিবপুর বোটানিক্যাল উদ্যানে যেতেন নিয়মিত। জাদুঘরে লাঠি নিয়ে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল বলে সঙ্গীর কাঁধে ভর রেখে চলতে হত। সঙ্গীর হাতে থাকত বই। সেখানে ছাপা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে নিতেন প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু।


৩৮ রকমের বৃক্ষ, ১৫ রকমের ফুল বা সুদৃশ্য নানা গাছ, ১৬ রকমের মশলাজাতীয় গাছের কথা পাওয়া যায় নানা জনের বিবরণে। নিরিবিলি প্রকৃতির সান্নিধ্যে বালির বাড়িতে বসে নিরলস গবেষণার ভিত্তিতে আমৃত্যু যে কাজগুলো করে গেছেন সেগুলো আমাদের অক্ষয় ঐতিহ্য, অমূল্য ঐতিহ্য। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমরা তাঁকে উপযুক্ত গুরুত্ব দিইনি, আজও দিচ্ছি না। তিনি যে সময় কালজয়ী কাজগুলো করে গেছেন, তখন বাংলাদেশে দ্বিতীয় ব্যক্তি ছিল না এইসব কাজ করার।


বালির বাড়িতেই একা, নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন ‘ধর্ম্মনীতি’র লেখক। পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে দূরত্ব ছিল। অম্বিকাচরণ চট্টোপাধ্যায় ও রামচন্দ্র রায় তাঁর দেখাশোনা করতেন। ১৮৮৬ সালের ১৮ মে জ্ঞানতাপস অক্ষয়কুমার দত্ত ছেষট্টি বছর বয়সে যখন প্রয়াত হন, তখন তাঁর পৌত্র সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের চার বছর বয়স। এই সত্যেন্দ্রনাথই পরে বাংলা কবিতায় ‘ছন্দের জাদুকর’ বলে খ্যাত। পিতামহকে ‘হোমশিখা’ কাব্যগ্রন্থ উৎসর্গ করে লিখেছিলেন ‘বঙ্গীয় গদ্যের গৌরবস্থল/ আমার পূজ্যপাদ পিতামহ…।’


চিনি, ময়দা, সুতার কল, কাগজের কল, টাঁকশালে যেতেন অক্ষয়কুমার, যন্ত্রবিজ্ঞান কী ভাবে কাজ করে দেখবেন বলে। সমুদ্রভ্রমণে গিয়ে দূরবিন চোখে পৃথিবীর গোলাকৃতির পরীক্ষা করতেন, জাহাজের ক্যাপ্টেনের সঙ্গে আলোচনা করতেন নানা দেশ নিয়ে। ইচ্ছে করে বারবেলা, কালবেলা, কালরাত্রি, অশ্লেষা, মঘা, ত্র্যহস্পর্শ প্রভৃতি ‘অশুভ’ দিনক্ষণ দেখে ভ্রমণে বেরোতেন। গ্রামে গ্রামে ঘুরে ‘পল্লীগ্রামস্থ প্রজাদের দুরবস্থা’র শরিক হতেন। বাংলা ও ইংরেজি ছাড়াও জানতেন সংস্কৃত, গ্রিক, ল্যাটিন, হিব্রু, ফরাসি ভাষা। বিজ্ঞানের ইতিহাস চর্চা ছাড়াও গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ভূগোল, ভূতত্ত্ব, উদ্ভিদবিদ্যা, নৃবিজ্ঞান, বিবর্তনতত্ত্ব, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, ভারতের পুরাতত্ত্বের চর্চা করেছেন।


নিরিবিলিতে বালির বাড়িতেই রচনা করেছিলেন তাঁর বিখ্যাত বই ‘ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়’। হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছিলেন এই অসাধারণ বইটির জন্য অক্ষয়কুমার দত্তের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এই বইয়ের দুটি খণ্ড এই বাড়িতে বসেই তিনি লেখেন। প্রথম খণ্ড ১৮৭০ সালে প্রকাশিত হয়, দ্বিতীয় খণ্ড তেরো বছর পর ১৮৮৩ সালে প্রকাশিত হয়। 


অক্ষয় দত্তের এই একখানা মাত্র বই কালের অবলেপন এবং উত্তরসূরিদের অবহেলার কবল থেকে বেঁচে গেছে। আমাদের কাছে তাঁর প্রদত্ত ‘অক্ষয়’ সম্পদ হয়ে টিকে থেকেছে। ভারতবর্ষের উপাসক সম্প্রদায়ের ইতিহাস মানে তো ভারতের যাবতীয় ধর্মীয় সম্প্রদায়েরই ইতিবৃত্ত বর্ণন। মনে হয়, তিনি সচেতনভাবেই ধর্মীয় শব্দটি বাদ দিয়ে উপাসক শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ভারতে ধর্মীয় সম্প্রদায়ের সংখ্যা নেহাত খুব কম নয়। তিনি হাত দিলেন একশ বিরাশিটি সম্প্রদায়ের কাহিনিতে। পুরোটাই তিনি একা নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করে করে সম্পন্ন করেছেন। বইপত্র পড়ার পাশাপাশি সরাসরি ক্ষেত্রসমীক্ষা করে অনেক রকম তথ্য পেয়েছেন। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সঙ্গে থেকেছেন, মিশেছেন, কথা বলেছেন, বুঝেছেন। তবে লিখেছেন। এই কারণেই ভারতীয় সমাজ তথা ধর্মীয় সমাজের সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের সাপেক্ষে বইটির আজও একটি আকর গ্রন্থমূল্য আছে। 


আরও লক্ষণীয়, যুক্তিবাদী বিজ্ঞানলেখক অক্ষয়কুমার দত্ত প্রথম বইটিতে ভারতবর্ষের বহু বিচিত্র ধর্মসংস্কৃতি বিশিষ্ট মানব গোষ্ঠী সম্পর্কে তাঁর বহুদিনের পরিশ্রমজাত ও বৈজ্ঞানিক বিধিসম্মত অনুপুঙ্খ ক্ষেত্রসমীক্ষার ফলাফল লিপিবদ্ধ করেছেন; আর দ্বিতীয় বইতে তিনি তাঁর নিজস্ব দার্শনিক বিচার, ভারতীয় চিন্তাশীলদের বিভিন্ন দার্শনিক মতের পরিচয়, পারস্পরিক তর্কবিতর্ক খণ্ডন-বিখণ্ডন, ভারতীয় প্রাচীন মনন-ঐতিহ্যে নিরীশ্বরবাদ এবং বস্তুবাদের নানা শাখার উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ, ভারত গ্রিস ও রোমের প্রাচীন সংস্কৃতির মধ্যে ভাষা তথা অন্য নানা বিষয়ে সাদৃশ্য, ইত্যাদি বহু চিত্তাকর্ষক বৌদ্ধিক উপকরণ তুলে ধরেছেন। এখানে আছে শুধু যুক্তিবাদী বিচারধারা নয়, যুক্তিবাদের মননশীল ফসল। এতে পাওয়া যায় শুধু মাত্র বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আবাহনী নয়, আগমনি নয়, তার পাশাপাশি আমরা পাই সমাজ সংস্কৃতি ভাষা দর্শন ইত্যাদি ক্ষেত্রে অখণ্ড বিজ্ঞানমানস প্রয়োগের ফলস্বরূপ এক উৎকৃষ্ট বিচারপদ্ধতি ও অভাবিতপূর্ব সিদ্ধান্তরাশি। প্রথম বই শেখায়, কোনো একটি সমাজতাত্ত্বিক বিষয়ে কীভাবে তথ্যানুসন্ধান করতে হবে। দ্বিতীয় বই থেকে শেখা যায়, কোনো একটা দেশের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার সম্পর্কে দীর্ঘপ্রচলিত বিভ্রান্তিগুলিকে কীভাবে কাটানো যায়। বৈদিক সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর স্বাধীন ও মুক্তমন অধ্যয়নের দ্বারা অর্জিত উপলব্ধি তিনি পাঠকের কাছে তুলে ধরেন এইভাবে: “এখন বেদপ্রাণ হিন্দুমণ্ডলি! শ্রবণ কর! তোমাদের প্রাচীন মীমাংসকগণ অর্থাৎ বেদমন্ত্রের মীমাংসাকারী পূর্বকালীন আচার্যগণ না ঈশ্বরই মানিতেন না দেবতাই স্বীকার করিতেন। তাঁহারা নির্দেব ও নিরীশ্বর।” ম্যাক্সমুলার এই বইটি সম্বন্ধে জেনে অক্ষয়কুমার দত্তকে প্রসংসাসূচক চিঠি লেখেন। 


আসলে অক্ষয়কুমার আমাদের ভাবতে শিখিয়েছেন বিজ্ঞানের অ-আ-ক-খ, জীবন এবং প্রকৃতির সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক কি, তার নিগুঢ় তত্ত্বগুলি। তার জীবনী এবং রচনা সংগ্রহের সংকলক এবং ‘অক্ষয়-সুধা’ (১৯২৪) নামের পুস্তকের রচয়িতা শিবরতন মিত্র যা বলেছেন, বােধহয় সেটাই অক্ষয়কুমার সম্পর্কে এবং তার বিজ্ঞান-অনুসন্ধিৎসু মানসিকতা সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কথা। তিনি উপরােক্ত পুস্তকের ‘অক্ষয়কুমার দত্ত ও বঙ্গসাহিত্য’ শিরােনামে লিখেছেন, “অক্ষয়কুমার প্রধানত বৈজ্ঞানিক। আজ ইংরেজ জাতি, জৰ্ম্মাণ জাতি, ফরাসী ও মার্কিণ জাতি বৈজ্ঞানিকতায় সিদ্ধিলাভ করিয়াছে। কিন্তু বৈজ্ঞানিকতার প্রতিভা একদিনে হয় নাই। বৈজ্ঞানিকী বুদ্ধির অনুশীলনে, ইংরাজ জাতিকে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য মনীষী বেকন হইতে জন স্টুয়ার্ট মিল পর্যন্ত মনীষীগণ কি কঠোর তপস্যা এবং কি ভীষণ সংগ্রাম করিয়াছেন, তাহা চিন্তা করিলে বিস্মিত হইতে হয়। ...এই মানুষকে প্রত্যক্ষ্য স্কুল ও ইন্দ্রিয় গ্রাহ্য ব্যাপার সমূহ পর্যবেক্ষণ করাইয়া অধ্যবসায় সহকারে সেই সমুদায় বিষয়ের শ্রেণীবিভাগ করিবার সহিষ্ণুতায় দীক্ষিত করিতে বেকনকে অনেক পরিশ্রম করিতে হইয়াছিল। আজ ইংরাজ যে গৌরবান্বিত, তাহার কারণ এই বৈজ্ঞানিকতা। অক্ষয়কুমার আমাদের দেশে এই বৈজ্ঞানিকতার প্রতিষ্ঠার জন্য তপস্যা করিয়াছিলেন এবং সেই কঠোর তপস্যায় আত্মবিসৰ্জন করিয়াছিলেন। বৈজ্ঞানিকের যাবতীয় লক্ষণ অক্ষয়কুমারের চরিত্রে পরিদৃষ্ট হয়।”


'বিদ্যাসাগর পুরস্কার' প্রাপক গবেষক আশীষ লাহিড়ী আক্ষেপ করে বলেছেন, ‘ভারতীয় উপাসক সম্প্রদায়’ বইটি যদি ইংরেজিতে তর্জমা করা যেত তবে প্রমাণ করা যেত তাঁর চিন্তাধারার স্বাতন্ত্র্য অন্যদের থেকে কতযুগ এগিয়ে ছিল। সেটা সামাজিক দিক থেকে, দার্শনিক দিক থেকে, ইতিহাসের দিক থেকে এমনকি সাহিত্যগত দিক থেকে। বাংলাদেশের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও অক্ষয়কুমার দত্ত গবেষক সাইফুল ইসলামের কথায়, 'আমরা যা কিছু আত্মসাৎ করতে পারি না তা ভস্মসাৎ করার চেষ্টা করি। ওনার ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য। ওনার পাণ্ডিত্য, অকাট্য যুক্তির জন্য তৎকালীন বঙ্গসমাজ ওনাকে আত্মসাৎ করতে পারেনি।'


৩৬৭, জিটি রোড, বালি, হাওড়ায় তাঁর সাধের শোভনোদ্যান বাড়িটি এখন ভগ্নপ্রায়, অন্তিম দশা। আজ অবধি কোনো দেখভাল, সংরক্ষণ হয়নি। যদিও ২০০৬ সালে তদানীন্তন রাজ্য সরকার ‘হেরিটেজ’ -এর একটি ফলক লাগিয়েই তার দায়িত্ব সম্পাদন করেছে। বর্তমান সরকারও উদাসীন। এখন বাড়িটির অবস্থা করুণ। অতিসত্বর আশু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। বহু স্মৃতিবিজড়িত বর্তমানে জরাজীর্ণ বাড়িটিকে সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করে অক্ষয়কুমার দত্তের কাজের উপর একটা গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তুলতে পারলে আপামর বাঙালি তথা ভারতবাসীরই উপকার হবে।


বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অক্ষয়কুমার দত্ত বিদ্যাসাগরের সমসাময়িক। অর্থাৎ তাঁরও দুশো বছর পূর্ণ হল। ২০২০ সালের, ১৫ জুলাই বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার পথিকৃৎ ও প্রথম বাঙালি সমাজবিজ্ঞানী অক্ষয়কুমার দত্তের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যে সকল কারণে আমাদের হৃদয়জুড়ে আছেন ঠিক একই কারণে বা তার চেয়েও বেশি কারণে অক্ষয়কুমার দত্ত প্রাতঃস্মরণীয় হওয়ার কথা। কিন্তু এই মহান মনীষীর আদর্শ, চিন্তাধারা, অক্ষয় কাজ কোন কিছুই আমরা সঠিক মূল্যায়ন করিনি। আজও করছি না।


বাঙালি তাঁকে খুব যে মনে রেখেছে, বলা যাবে না। অবশ্য ঘটা করে প্রতি বছর তাঁর ছবিতে ফুলচন্দন দিলে বা পঞ্চধাতুর মূর্তি স্থাপন করলেও খুব কিছু এসে যেত না। বেঁচে থাকতেই ভাববাদের উল্টো পথের এই একলা পথিক লিখেছিলেন: ‘যদি বা আমার কীর্ত্তি স্থায়ী হয়, কিন্তু আমি তো চিরস্থায়ী নই।… মৃত্যুর পরে আমি সে কীর্ত্তি ঘোষণা শুনিতে আসিব না।’


ধর্মতত্ত্ব থেকে ভাষাবিজ্ঞান পর্যন্ত যে দীর্ঘপ্রকার জ্ঞানভূমির মধ্যে ছিল তাঁর অনায়াস পদচারণা, বাঙালি পাঠককে হাত ধরে সেই জ্ঞানজগতের সিংহদ্বারে তিনিই পৌঁছে দিয়েছিলেন। তাই তাঁর কাছে আধুনিক ভারতবাসীর ঋণ অপরিশোধ্য। মাতৃভূমি থেকে যাবতীয় অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কার, কদাচার ও দুর্বলতা দূর করাই ছিল অক্ষয়কুমার দত্তের ব্রত। তাই মনে প্রশ্ন জাগে, কেন ভারতের যুক্তিবাদীরা এযাবৎ অক্ষয়কুমার দত্তকে বিদ্যাসাগরের পাশাপাশি সমান গুরুত্ব এবং শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে সামনে তুলে আনার প্রয়াস করলেন না? বিনয় ঘোষ, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখর ভারতীয় দর্শন ও প্রাচীন সামাজিক সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নিয়ে এত ভালো ভালো কাজ আছে, অথচ তাতে অক্ষয়কুমার দত্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেলেন না কেন, “ভারতবর্ষীয় উপাসক সম্প্রদায়” বইটি কোন জায়গা আদায় করতে পারল না কেন - মনে জাগে বিস্ময় প্রশ্ন। দুর্ভাগ্যবশত তাঁর মৃত্যুর পর ক্রমে ক্রমে বাঙালিদের চিন্তা জগত থেকে তিনি কার্যত বিস্মৃতির অন্তরালে তলিয়ে গেছেন। বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে অক্ষয়কুমার দত্তের আদর্শ ও দর্শন খুবই প্রাসঙ্গিক। বর্তমানে ধর্মীয় উন্মাদনা ও অন্ধবিশ্বাসের যাঁতাকলে অনেকক্ষেত্রে আমরা আলোর থেকে অন্ধকারের দিকে এগোচ্ছি। এটা যদি ঠেকাতে হয় তবে সবচেয়ে বড়ো হাতিয়ার আমাদের কাছে অক্ষয়কুমার দত্ত।           


★ তথ্যঋণ ও কৃতজ্ঞতা স্বীকার: আনন্দবাজার পত্রিকা, দীপক সাহা - আপনপাঠ ওয়েবজিন, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান (১ম খণ্ড), গবেষক আশীষ লাহিড়ী, গবেষক ও শিক্ষক অর্ণব চ্যাটার্জি, শিবপ্রসাদ মিত্র, শিক্ষক অনু বর্মন, সাহিত্যিক কুশল মৈত্র, সুকুমার সেন - 'বাংলার সাহিত্য ইতিহাস', সাহিত্য অ্যাকাদেমি, নতুন (পৃঃ ১৬৭), আমিনুল ইসলাম - নবজাগরণ ডট কম, সংবাদ ডট নেট ডট বিডি।

আমাদের কথা


এই দুর্নিবার সময়েও লেখনী চালিয়ে যাওয়ার মত ধীশক্তি ধরে রেখে মুক্তচিন্তকরা নিরন্তর লিখে চলেছেন। তাঁদের লেখাগুলি সংকলিত করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে চেতনার অন্বেষণে পত্রিকা। যা দুই বাংলার পাঠকদের কাছে দ্রুত সমাদৃত হয়। এই পথ চলার একটি ধাপে এসে অন্বেষণ পাবলিশার্স পথ চলা শুরু করেছে মূলত মুক্তচিন্তা ও বিজ্ঞানমনস্ক বইগুলিকে পাঠকের কাছে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে। আমাদের কথা বলতে লেখক, পাঠক সবাই মিলিয়েই আমরা।

ওয়েবসাইট প্রসঙ্গে


এটি মূলত বিজ্ঞানমনস্কতা, যুক্তিবাদ চর্চা এবং বইপত্রের প্ল্যাটফর্ম। এই ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যুক্তিবাদীদের লেখার চর্চাকে অনুপ্ররণা যোগাবে। লগইন করে আপনিও লিখতে পারবেন, ওয়েবসাইটটি সমস্ত বিজ্ঞানমনস্ক, যুক্তিবাদীদের উদ্দেশ্যে নির্মিত।

যোগাযোগ


Email: yuktibadira@gmail.com

WhatsApp: +91-9433794-113


Website visit count:
86930